১৬ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৫৭

মৃত্যু-শনাক্তে হঠাৎ লাফ

ঢামেকে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির স্বজনের আহাজারি ছবি: জীবন আহমেদ

দেশে করোনার সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। চলতি মাসের শুরু থেকেই শনাক্ত ঊর্ধ্বমুখী। এই ধারায় দেশে গতকাল তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্তের হিসাব দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। একইভাবে ৯ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু। কিন্তু হঠাৎ কেন বাড়ছে রোগী ও মৃত্যু। এর কোনো স্পষ্ট কারণ জানা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি ভুলে যাওয়ায় পরিস্থিতি এমন হয়েছে। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না অনেক দিন থেকে।
তাই এ কারণেই শুধু সংক্রমণ বাড়ছে- তা হতে পারে না। অন্যকোনো কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, বৃটেনে পাওয়া করোনার নতুন ধরন দেশে পরিস্থিতি খারাপের কারণ হতে পারে। কারণ জানুয়ারিতে এটি দেশে ধরা পড়লেও অনেক পরে প্রকাশ করা হয়েছে। এই সময়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে কিনা এরও কোন গবেষণা নেই।

বাংলাদেশে ১০ জনের বেশি রোগীর মাঝে নতুন স্ট্রেইন পেয়েছে আইইডিসিআর। অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে হঠাৎ করে ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে বৃটেনের নতুন স্ট্রেইনটি।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন মানবজমিনকে বলেন, বৃটেন থেকে দেশে আসা ১০ জনের বেশি রোগীর মধ্যে করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের সন্ধান পেয়েছি। তবে এই সংখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে। তিনি জানান, জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাস শনাক্ত করা গেছে। তিনি আরো জানান, এই উচ্চ সংক্রামক বৃটেনের নতুন স্ট্রেইনটি এখনো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন না। দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে করোনার এই নতুন স্ট্রেইনকে তিনি এখনই দায়ী করতে চান না। অধ্যাপক তাহমিনা বলেন, গবেষকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন জিনোম সিকোয়েন্সিং বাড়ানোর জন্য, যাতে এ ধরনের রোগী আরো থাকলে তাদের শনাক্ত করা যায়। জিনোম সিকোয়েন্সিং একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং আমরা নিয়মিতভাবে এটা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মূল রূপ থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে বৃটেনের নতুন স্ট্রেইনটি তৈরি হয়েছে। আমরা অন্যান্য স্ট্রেইনগুলো নিয়েও গবেষণা করছি। অধ্যাপক তাহমিনা দাবি করেন, আমরা বৃটেনের নতুন স্ট্রেইন এবং সামপ্রতিককালের বেড়ে যাওয়া সংক্রমণের হারের মাঝে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাইনি। বরং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই সংক্রমণ বাড়ছে।

বৃটেনের নতুন স্ট্রেইন ‘এন৫০১ওয়াই’ বাংলাদেশে সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় গত ৫ই জানুয়ারি। আক্রান্ত ব্যক্তি বৃটেন থেকে দেশে ফিরেছিলেন। ঢাকা ও সিলেটেও এই ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে।

দেশে হঠাৎ করে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পিছনে কী কারণ দেখছেন জানতে চাইলে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, জানতে পেরেছি কম বয়সীরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন। এতে সন্দেহ হচ্ছে বৃটেনের নতুন স্ট্রেইন আমাদের এখানে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ বৃটেনে নতুন স্ট্রেইনে তরুণরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এই নতুন স্ট্রেইনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরোলজিস্ট আরো জানান, নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হওয়ার খবরে চারদিকে ইতিমধ্যেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। স্কুল-কলেজ এই মুহূর্তে খোলা যাবে না। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে সরকারের বৈঠকে এটাই পরামর্শ দেয়া হবে বলে জানান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের এখানে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। কারণ এটা খুবই ব্যয়বহুল। দেশে বৃটেনের নতুন স্ট্রেইন কী পরিমাণে ছড়িয়েছে তা জানার জন্য আরো বেশি জিনোম সিকোয়েন্সিং করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার জন্য সরকারকে জরুরিভাবে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে এবং যেসব গবেষণাগার এটি করতে পারে তাদের এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে হবে। তিনি আরো জানান, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলার অনীহা এবং ‘টিকা নিলে আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই’- বলে যে প্রচলিত ভুল ধারণা, তার কারণেও ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, সংক্রমণের হার, হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই জিনোম সিকোয়েন্সিং ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা বুঝতে পারবো টিকা কতটা ভালো কাজ করছে। কিছুদিন ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার কমতে থাকায় মানুষ যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৮৩টি দেশে বৃটেনের নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, আগের রূপের চেয়ে বৃটেনের নতুন স্ট্রেইনটি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি মারাত্মক হতে পারে। ফেব্রুয়ারিতে বৃটেন সরকার কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো এই রূপটি চিহ্নিত করার পর থেকে বেশির ভাগ করোনা রোগীই এই স্ট্রেইনে আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, ভারতে তিন ধরনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২৪২ জন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বৃটেনের নতুন স্ট্রেইনে আক্রান্ত। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ সরকারের বিজ্ঞানীরা অন্য সব স্ট্রেইনের তুলনায় বৃটেনের নতুন স্ট্রেইনটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। এতে আরো বলা হয়েছে, বৃটেনের এই নতুন স্ট্রেইন হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি আরো বাড়িয়েছে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=266439&cat=2