১৬ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:৫৭

করোনা রোগী ভর্তির চাপ বাড়ছে

আইসিইউ সংকট হাসপাতালে

নতুন ভেরিয়েন্টে বেশি আক্রান্ত কম বয়সিরা * তিন দিনে ভর্তি ২৮৭৬, আইসিউতে আছেন ২৬৫ জন

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা রোগীর ভিড় বাড়ছে। গত তিন দিনে ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি মিলে ১৯ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৮৭৬ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে আছেন ২৬৫ জন। ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার সংকট দেখা দিয়েছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে হাসপাতালে সাধারণ শয্যারও সংকট দেখা দিতে পারে।

রোগী ভর্তির পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার জন্যও হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অনেক মানুষকে। টিকা প্রয়োগ সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বগতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। সব মিলে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণে নতুন দুটি ভেরিয়েন্ট পাওয়া গেছে। যার সঙ্গে ইউকের অত্যধিক সংক্রমণকারী ভেরিয়েন্টের মিল রয়েছে। এবার অপেক্ষাকৃত কম বয়সিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এদিকে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের অভাবে আইসিইউতে মুমূর্ষু করোনা রোগীদের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে।

দেশে মাত্র দু’সপ্তাহ আগেও রোগী শনাক্তের হার ছিল ৫ থেকে ৭ শতাংশ। বর্তমানে ২১ থেকে ২৪ শতাংশে পৌঁছেছে। সোমবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা গত নয় সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ। দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৭৭৩ জন। যা তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর এর চেয়ে বেশি ১ হাজার ৮৭৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। আর এক দিনে এর চেয়ে বেশি মৃত্যু হয় চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ৩১ জন। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় পরীক্ষার তুলনায় দৈনিক শনাক্তের হারও ২৭ ডিসেম্বরের পর প্রথমবারের মতো ৯ শতাংশ অতিক্রম করেছে।

গত একদিনে পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সোমবার সকাল পর্যন্ত আরও ১ হাজার ৭৭৩ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ৫ লাখ ৫৯ হাজার ১৬৮ জন হয়েছে। আর গত এক দিনে মৃত ২৬ জনকে নিয়ে দেশে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৭১ জন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ কয়েক প্রকারের করোনাভাইরাসের ভেরিয়েন্ট। প্রথম করোনাভাইরাসের যে ভেরিয়েন্ট সারাবিশ্বে সংক্রমণ ঘটিয়ে ছিল সেটি কোভিড-১৯। এরপর দ্বিতীয় ভেরিয়েন্টের নাম ইউকে ই-১১৭, তৃতীয় ভেরিয়েন্টের নাম ইউকে ই-১৫২৫, চতুর্থ সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট ই-১৩৫, পঞ্চম ভেরিয়েন্ট ব্রাজিলিয়ান পি-১।

পৃথিবীর সব দেশে সব ভেরিয়েন্ট এখনো বিস্তার লাভ করেনি। যে টিকাগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো বেশিরভাগ ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু কোনো কোনো ভেরিয়েন্টের ব্যাপারে কাজ করে না বা কাজ করে কিনা এটা এখনো প্রমাণিত হয়নি। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত না হয়, ততদিন পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে যে পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটি হলো নতুন আক্রান্ত রোগীদের ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করা। ইতোমধ্যে রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শনাক্ত ১০ জন রোগীর জিন বিশ্লেষণ করেছেন।

যার মধ্যে ১টি সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট এবং বাকিগুলো ইউকে ভেরিয়েন্টের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। তাছাড়া দেশের বর্তমান সংক্রমণ ইউকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেখানে করোনা রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) ও এইচডিইউ (হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট) ওয়ার্ডে সিনিয়র চিকিৎসক থাকেন না।

৩৯ বিসিএসের মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের এসব স্পর্শকাতর স্থানে কাজ করতে দেওয়া হয়েছে। তাদের বেশির ভাগের এসব জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা নেই। উপরন্তু তারা ওয়ার্ডে না গিয়ে নার্সদের পাঠানো রোগীর অবস্থা দেখার জন্য। ফলে প্রতিদিনই এখানে অব্যবস্থাপনা বাড়ছে।

অচেতন রোগীকে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল না দিয়ে শিরাপথে সেডিল ইনজেকশন দিলে রোগীর অবস্থার অবনতি হয়। এই ইনজেকশনটি মূলত ঘুমের জন্য ব্যবহার করা হয়। অথচ ওই রোগী অচেতন ছিলেন। পরে রোগীর ফাইলে সেই অর্ডার কেটে দেওয়া হয়।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, সারা দেশে মানুষ আছে ১৬ কোটি, টিকা নিয়েছে অর্ধকোটিরও কম। যারা টিকা নিয়েছেন তারা সমাজের অপেক্ষাকৃত সচেতন, শিক্ষিত অংশ। তারা জানেন টিকার কার্যকারিতা পেতে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরও কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ সময় প্রয়োজন।

সুতরাং তারা মাস্ক পরা বাদ দেননি। বাদ দিয়েছেন যারা টিকা নেননি তারা। তিনি বলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের আরটিপিসিআর ল্যাবে গত তিন দিনের পজিটিভ রোগীর হার যথাক্রমে ২১ শতাংশ, ১৮ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ। যেটি গত দুই মাস ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ছিল।

তিনি বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কেবল কক্সবাজারে মানুষ হয় ২ থেকে ৩ লাখ। প্রতিটি কমিউনিটি সেন্টার এবং ওয়াজ মাহফিলে হাজার হাজার মানুষ কয়েক ঘণ্টা গাদাগাদি করে মাস্কবিহীন অবস্থায় থাকে। এসব স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালন করার আহ্বান না জানিয়ে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। তবে এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ অধিদপ্তরের হাতে নেই। ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউ’র বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। বারবার হাত সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। অহেতুক জনসমাবেশে যোগদান থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলো মেনে চলতে পারলে ধীরে ধীরে আবারও করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

ইউরোপে নতুন করে লকডাউন : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবারও বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এর মধ্যে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ডে করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েকটি দেশে আবারও লকডাউন জারি হয়েছে। খবর দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের।

বাংলাদেশ সময় সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১২ কোটি ৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১০ কোটি লোক সুস্থ হয়েছেন। মারা গেছেন ২৬ লাখ ৬৬ হাজার। বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন তিন কোটির বেশি, মারা গেছেন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এ তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্রাজিল ও ভারত।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/402270/