১৫ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১০:৫৪

রমযানের আগে ভোজ্যতেলের মূল্য সর্বোচ্চ নির্ধারণ

তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে -বাণিজ্যমন্ত্রী

পবিত্র রমযান মাস আসতে আর মাত্র এক মাস বাকি। ইতোমধ্যে সরকার রমযানের আগেই এক মাসের ব্যবধানে দুই দফা বাড়িয়ে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্যে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করেছে। সর্বশেষ দাম অনুযায়ী এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের দাম মিল গেইটে ১২৭ টাকা, ডিলার পর্যায়ে ১৩১ এবং খুচরায় ১৩৯ টাকা ঠিক করা হয়েছে। এর আগে সরকার গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। বোতলের প্রতি লিটার সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১২৭ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এটা ছিল ২০১২ সালের নির্ধারিত তেলের দামের সমান। সেই সময় ভোজ্যতেলের দাম ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন সব রেকর্ড ভেঙ্গে সরকারিভাবে সর্বোচ্চ তেলের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। ইতোমধ্যে তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। তবে তেলের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে রোজার আগে আরেক দফা দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে এক মাসের ব্যবধানে দুইবার তেলের দাম বাড়ালো সরকার। আর এই দাম দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সর্বশেষ নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ২টাকা এবং বোতলজাত তেলে ৪ টাকা বাড়ছে। গতকাল সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভায় তেলে দাম পুননির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয় বলে মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। মিল গেইটে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৩ টাকা, আর খুচরা বাজারে বিক্রি হবে ১১৭ টাকা দরে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এই তেলের দাম মিল গেইটে ১০৭ টাকা এবং খুচরায় ১১৫ টাকা নির্ধারণ করা ছিল। দাম পুনর্র্নিধারণে এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের দাম মিল গেইটে ১২৭ টাকা, ডিলার পর্যায়ে ১৩১ এবং খুচরায় ১৩৯ টাকা ঠিক করা হয়েছে। আর ৫ লিটারের বোতল মিল গেইটে ৬২০ টাকা, ডিলার পর্যায়ে ৬৪০ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৬৬০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা পাম তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে মিল গেইটে ১০৪ টাকা, ডিলার পর্যায়ে ১০৬ টাকা এবং খুচরায় ১০৯ টাকা।

এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভায় প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিল গেইটে ১২৩ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১২৭ টাকা এবং খুচরায় ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম মিল গেইটে ৫৮৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ৬০০ টাকা এবং খুচরায় ৬২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে যে তেল ব্যবহার হয়, তার ৭০ শতাংশই পাম সুপার। আগে এর প্রতি লিটারের দাম ছিল মিলগেইটে (খোলা) ৯৫ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ৯৮ টাকা এবং খুচরা বাজারে ১০৪ টাকা। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানান হয়, গত জুলাই মাস থেকে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও অপরিশোধিত পাম তেলের দাম বাড়ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম (এফওবি) ১ হাজার ২৭৫ ডলার এবং পাম তেলের দাম (এফওবি) ১ হাজার ৩৭ ডলার। পাশাপাশি পরিবহন খরচ ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ এবং বোতলের কাঁচামাল রেজিনের দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানান হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্যে অস্থিতিশীলতা থাকায় আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী স্থানীয় মূল্য সমন্বয়ের লক্ষ্যে জাতীয় কমিটি দেশের পরিশোধনকারী মিল ও ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনায় সভা করেছে। জানা গেছে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন, যার প্রায় সবই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। বিগত জুলাই মাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও অপরিশোধিত পাম তেলের বাজার মূল্যে ঊর্ধ্বমূখী প্রবণতা দেখা যায়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেট্রিক টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের এফওবি মূল্য ১ হাজার ২৭৫ মার্কিন ডলার এবং অপরিশোধিত পাম তেলের এফওবি মূল্য ১ হাজার ৩৭ মার্কিন ডলার। এসব অপরিশোধিত তেল পরিবহণ ব্যয় বিগত কয়েক মাসে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিশোধিত সয়াবিন তেল বোতলজাত করতে বোতলের কাঁচামাল রেজিনের মূল্য বিগত কয়েক মাসে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বলছে, রমজানকে সামনে রেখে ভোজ্যতেল যৌক্তিক মূল্যে যেন বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত হয় সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে বাজারে টিসিবি’র মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বৃদ্ধির বিষয়েও কাজ করা হচ্ছে। অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেল আমদানিতে আরোপিত ভ্যাট ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় রেখে যৌক্তিক হার নির্ধারণের জন্য ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবি আর) অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম দুই টাকা এবং বোতলজাত তেলে চার টাকা বাড়ানো হয়েছে। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেশি থাকায়, দেশের বাজারে সমন্বয় করা হয়েছে। দাম কমলে আবার সমন্বয় করা হবে।
এদিকে সম্প্রতি বিবিএস ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন বিবিএসের ন্যাশনাল একাউন্টিং উইংয়ের পরিচালক (মূল্য ও মজুরি) মো. আবদুল কাদির মিয়া। তিনি বলেন, চাল, ব্রয়লার মুরগি, ভোজ্য তেল, চিনি ইত্যাদির বাড়তি দাম থাকায় গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মাসটিতে জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হয়েছে ৫ দশমিক ৩২ ভাগ। যা জানুয়ারিতে ছিল শতকরা ৫ দশমিক শূন্য ২ ভাগ। জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে দশমিক ৩০ ভাগ। তার দেয়া তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারিতে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত উপ-খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে শতকরা ৫ দশমিক ৪২ ও ৫ দশমিক ১৭ ভাগ। যা জানুয়ারিতে ছিল যথাক্রমে শতকরা ৫ দশমিক ২৩ ও ৪ দশমিক ৬৯ ভাগ।
মূল্যস্ফীতির হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যালোচনায় দেখা যায়, চাল, ব্রয়লার মুরগি, ভোজ্য তেল, চিনি ইত্যাদির মূল্য চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে বেড়েছে। অপরদিকে আলু, পেঁয়াজ, শাক-সবজি (বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, মুলা, টমেটো, গাজর ইত্যাদি), ফল (আঙুর, বরই ইত্যাদি) এবং মশলা (জিরা, দারুচিনি) ইত্যাদির মূল্য জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে কমেছে। গত এক বছরের (২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) চলন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে শতকরা ৫ দশমিক ৬৩ ভাগ। পূর্ববর্তী একই সময়ে (২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) চলন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে শতকরা ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের পরিচালক (মূল্য ও মজুরি) মো. আবদুল কাদির মিয়া বলেন, ‘মূল্য কী কারণে বেড়েছে, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেটা জানি। জিনিসের দাম বেড়েছে, তাই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়ানোর সুযোগ দেওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়লে ভোগান্তি বাড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের।

বিক্রেতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে দেশে সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১২ সালে। তখন ব্যবসায়ীরা এক লিটারের বোতলের দাম ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছিলেন। অবশ্য ব্যবসায়ীরা দুই বছর ধরে ভোজ্যতেলের তিন স্তরের বদলে এক স্তরে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আদায়ের অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও একাধিকবার এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবি আর) চিঠি দেয়। যদিও ভ্যাট ছাড় মেলেনি। ভোজ্যতেলে এখন আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৪ শতাংশ অগ্রিম কর, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। একটি কোম্পানি দাবি করেছে, তারা যে দরে পণ্য আমদানি করছে, তাতে এক লিটার সয়াবিনে ২৫ টাকার মতো করভার দাঁড়াচ্ছে। তবে সমস্যা হলো আমদানিতে দাম যত বাড়ে, সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়ে।

কারওয়ান বাজারের ক্রেতারা বলছেন, তেলের দাম তো প্রতি মাসেই বাড়ছে। সরকার এখন তো কিছু ছাড় দিতে পারে। তেলের দাম বাড়ায় দেশের মানুষের জীবনযাপনের খরচ আরো বাড়লো। তেলের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা নিত্যপণ্যের দামকে আরো উসকে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে, ব্যাপকভাবে চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্টদের মতে, জীবনযাত্রার ব্যয় যে হারে বাড়ছে; ওই অনুপাতে আয় না বাড়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা পড়েছেন বিপাকে। পারিবারিক ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। আয় ও ব্যয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করেও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কেননা মাসিক আয়ের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগই ব্যয় হয় বাড়ি ভাড়ায়। সঙ্গে যোগ হয় সন্তানদের স্কুল-কলেজের বেতন, যাতায়াত ভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে।

ক্যাবের গত বছরের জরিপের তথ্যমতে, গত এক বছরে মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। বিপরীতে আয় বেড়েছে ৪-৬ শতাংশ। আয় আর ব্যয় ব্যবধান বেড়েছে ১০-১১ শতাংশ। এদিকে, রমজান আসতে এখনো এক মাস বাকি। এরই মধ্যে হু হু করে বাড়ছে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, রসুন, আদা, মাছ, মুরগি, দুধ, ডিম, খেজুরসহ সব কিছুরই দাম বাড়তি। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চাপে মধ্যবিত্তের এখন টিকে থাকাই দায়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতি সব সময়ই নিম্ন ও মধ্য শ্রেণির মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। এবার সেটা একটু বেশিই হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনে এর প্রভাব পড়বে। এছাড়া সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়বে।

https://dailysangram.com/post/446743