১৫ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১০:৫৩

ফার্মগেটের রাস্তা ও ফুটপাত অবৈধ ব্যবসায়ীদের দখলে

রাজধানীর বিভিন্নস্থানে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে চলছে অবৈধ দখল উচ্ছেদ। সাম্প্রতিক সময়ে খাল, রাস্তা, ফুটপাত, ওভারব্রীজসহ সর্বত্র এই অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান প্রশংসিতও হচ্ছে। যদিও উচ্ছেদ অভিযানের পর আবারও দখল হচ্ছে খাল, রাস্তা, ফুটপাত। তবে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো খুবই দরকার হলেও সেখানে সিটি করপোরেশনের চোখই পড়ছে না। যান চলাচলসহ জনজীবনে নাভিশ্বাস দেখা দিলেও ফার্মগেট ইন্ধিরা রোড ও তেজগাঁও কলেজের সামনের ফুটপাতে হকারদের দৌরাত্ম্যের যেন বৈধতা দিয়েছে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ। মেট্্েরারেলের নির্মাণ কাজের জন্য খামারবাড়ির সামনের রাস্তার পুরোটাই বন্ধ। তেজগাঁও কলেজের সামনের রাস্তাটিকে দুইভাগে বিভক্ত করে চালানো হচ্ছে যানবাহন। ফলে যানচলাচলে দীর্ঘ যানজট এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। একদিকে রাস্তা সংকুচিত, অন্যদিকে ইন্ধিরা রোড ও তেজগাঁও কলেজের সামনের ফুটপাত দখল করে চলছে হকারদের ব্যবসা। এমন অবস্থায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে জনগণ। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের জন্য একপাশের রাস্তা বন্ধ রাখা, অপর অংশকে ভাগাভাগি করে যানবাহন চলাচল করাতে যখন ব্যস্ততম ফার্মগেটে আসা জনগণের ত্রাহি অবস্থা, তখনও অচলাবস্থা নিরসনে দখলকৃত রাস্তা ও ফুটপাত খালি করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরেজমিনে দেখা গেছে, এমন চিত্র শুধু ফার্মগেটেই নয়, রাজধানীর অনেক স্থানেই রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য চলছেই।

সূত্রমতে, রাজধানীতে চলমান সব ক’টি রুটের যানবাহনের মিলনস্থল হিসেবে পরিচিত ফার্মগেট। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, নিউমার্কেট, সাভারসহ বিভিন্ন রুটের গণপরিবহন এই ফার্মগেট হয়েই মতিঝিল, মালিবাগ, চিটাগাং রোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। গণপরিবহনসহ ব্যক্তিগত পরিবহনের সংখ্যা এতো বেশী থাকে যে, ফার্মগেটের দীর্ঘ যানজট যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। এর সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প। মৎসভবন থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত রাস্তার একপাশ বন্ধ। যান চলাচলের জন্য খোলা থাকা তেজগাঁও কলেজের সামনের রাস্তাটির মাঝখানে ডিভাইডার। ফলে প্রতিনিয়ত এই রাস্তায় যানজট আগের তুলনায় বেড়েছে বহুগুণ। এই অচলবস্থার কিছুটা লাগব হতে পারত, যদি ইন্ধিরা রোড ও তেজগাঁও কলেজের সামনের ফুটপাত খালি থাকতো। তাহলে অন্তত জনগণ এটি দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারতো। কিন্তু এই রাস্তার পুরোটাই দখলে নিয়েছে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। মেট্রোরেলের কারণে যানচলাচলসহ জনগণের যাতায়াতে নাবিশ্বাস দেখা দিলেও রাস্তাসহ ফুটপাতটি খালি করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনেও রয়েছে অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ন।

জানা গেছে, অন্যান্য এলাকার মতোই রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা জুড়ে ফুটপাত দখল করে চার শতাধিক দোকান বসেছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর ফুটপাত দখলে থাকায় পথচারীদের হাঁটার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। বাধ্য হয়ে তারা চলাচলের জন্য ব্যবহার করছেন মূলসড়ক। ফলে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক যানজট। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।

ফার্মগেটের এই ফুটপাতের এক পথচারী শায়লা রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফুটপাতগুলো জমি দখলের মতো দখল হয়ে গেছে। মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের জন্য এমনিতেই হাঁটা কষ্টকর। তার উপর রাস্তাসহ ফুটপাত দখল করে চলছে দেদারসে ব্যবসা। এখনি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে এগুলো আর দখলমুক্ত করা যাবে না। পাপিয়া সুলতানা নামের আরেক পথচারী বলেন, ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত দখল থাকায় রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হয়, যা পথচারীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। বেশিরভাগ সময় রাস্তায় প্রচণ্ড যানবাহনের চাপ থাকে। তাই রাস্তা দিয়েও চলাচল করা যায় না। এরজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

সাভার থেকে এসে রাজধানীতে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী রফিকুল ইসলাম মিঞা বলেন, এমনিতেই মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের কারণে যানজট এখন নিত্যদিনকার ঘটনা। তবে ফার্মগেট পার হতেই এখন ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কারণে রাস্তা অর্ধেক করে যানচল করানো হচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে হকারদের দোকানপাট স্থাপনে এই যানজটের দীর্ঘসূত্রিতা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। ইন্ধিরা রোড ও তেজগাঁও কলেজের সামনের ফুটপাতটি অবিলম্বে দখল মুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

ফার্মগেট এলাকায় এমনিতেই সরকারি-বেসরকারি বহুস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রয়েছে বেশকিছু কোচিং সেন্টার ও মার্কেট। এসব কারণে ফুটপাত ও রাস্তাঘাট প্রতিদিনই মানুষে ভরপুর থাকে। তেজগাঁও কলেজ, ইন্দ্রিরা রোড ও ফার্মগেট মোড়ের এসব ফুটপাত দীর্ঘদিন ধরেই দখল হয়ে আছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। হকারদের জিম্মি করে এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিনই আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। ব্যবসায়ী ও হকারদের দেয়া তথ্যে অনুযায়ী, তেজগাঁও কলেজ, ইন্দ্রিরা রোড, আনন্দ সিনেমা হল সড়ক, গ্রিন রোড, খামারবাড়ি, হলিক্রস রোডসহ গোটা এলাকার ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় হয়। তিন শতাধিক দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ টাকা তোলা হয়। ফুটপাত দখল করে থাকা বিভিন্ন দোকানির সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চায়ের দোকানি বলেন, টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। এহানে বহার লাইগা প্রতিদিন টেকা দেওন লাগে। ৭০ বছর বয়সী একজন ডাব বিক্রেতা বলেন, আমার মতো বুড়ুরা মানুষের থেকে ২০০ টাকা লইয়া যায়। ফার্মগেটের তেজগাঁও কলেজ ইন্দ্রিরা রোড, আনন্দ সিনেমা হল সড়ক, গ্রিন রোড, খামারবাড়ি, হলিক্রস রোডসহ প্রায় সব ফুটপাতই হকারদের দখলে। জানা যায়, এসব ফুটপাতে ব্যবসা করতে হলে প্রত্যেক হকারকেই ১০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত এককালীন দিতে হয়। এরপর দৈনিক ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। টোল না দিলে ফুটপাতে ব্যবসাও করা যায় না।

সরেজমিনে দেখা গেছে , রাজধানীর শ্যামলী শিশুমেলা থেকে আগারগাঁও বেতার কেন্দ্র পর্যন্ত ফুটপাতটি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছিল অবৈধ দোকানপাট। ওই ফুটপাতটি দখলমুক্ত করতে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ওই সময় ফুটপাতে গড়ে তোলা অন্তত ৭০টি অবৈধ দোকান গুঁড়িয়ে দেয় ডিএনসিসি। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। গুঁড়িয়ে দেওয়া দোকানগুলোর স্থানে ফের বসানো হচ্ছে অবৈধ দোকান। এখানকার হাসপাতালগুলোর সামনের ফুটপাত দখল করে আবারও শুরু হয়েছে অবৈধ ব্যবসা।

সূত্র মতে, রাজধানীতে বারবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়। গণমাধ্যমে ফলাও করে সে সংবাদ প্রচারও হয়। কিন্তু পরিস্থিতি কিছুটা থিতু হয়ে এলে উচ্ছেদ অভিযান চালানো জায়গায় ফের গড়ে তোলা হয় অবৈধ স্থাপনা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর যদি আবারও সেখানে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়, তবে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে এসব উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার মানে কী?

চলতি বছরের শুরুতে বেশ ঘটা করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি। ইব্রাহিমপুর খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও বর্জ্য পরিষ্কারের মধ্য দিয়ে ডিএনসিসির উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় ৪ জানুয়ারি। ১২ জানুয়ারি শ্যামলীর শিশুমেলা থেকে আগারগাঁও বেতার কেন্দ্র পর্যন্ত ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান চালায় ডিএনসিসি। উচ্ছেদ করা স্থানে আবারও গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ দোকান। এরই মধ্যে ফের টিনের বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা অবৈধ দোকানগুলোতে দিব্যি চলছে বেচাকেনা। স্থানীয়রা বলছেন, ডিএনসিসি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে ঠিকই, পরে আর নজরদারি করছে না। একই সঙ্গে উচ্ছেদকারীদের নিয়েও নেই কার্যকর কোনো পরিকল্পনা। ফলে বারবার দখল হয়ে যাচ্ছে উদ্ধার করা জায়গা।

গত ২১ জানুয়ারি মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের ৩ নম্বর এভিনিউয়ের ৪ নম্বর সড়কে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ডিএনসিসি। ওই সময় উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, রাজধানীর সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। মিরপুরে উচ্ছেদ করা জায়গায় নতুন রাস্তা তৈরি করা হবে, যাতে জায়গাটি আর দখল করতে না পারে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নতুন রাস্তা তৈরির কোনো আলামত নেই। এমনকি এখনো সেখান থেকে সরানো হয়নি উচ্ছেদের বর্জ্য পর্যন্ত। এই বর্জ্যের কারণে পুরো এলাকা এখন ধুলায় ধূসর। আর দখলমুক্ত করা সড়কের ফুটপাতজুড়ে এরই মধ্যে ফের বসানো হয়েছে অন্তত তিন’শ অস্থায়ী দোকান। কোথাও কোথাও খুঁটি পুঁতে ছাউনি তুলে বাস করছে মানুষ।

উত্তর সিটির অধিভুক্ত মোহাম্মদপুর এলাকার রিংরোডে প্রতিদিন বিকেলের পর সড়ক দখল করে বসানো হয় শতাধিক অবৈধ দোকান। বসিলা নতুন রাস্তায় একইভাবে বসছে আরও দেড় শতাধিক দোকান। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, মিরপুর ১, ২, ১২ ও ১৪ নম্বর এলাকায় এ ধরনের অবৈধ দোকানের সংখ্যা হাজারের বেশি। এগুলো কেবল জনগণের চলার পথেই বাধা নয়, বরং সড়কের যান চলাচলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সূত্র জানায়, এসব অবৈধ দোকানের অলিখিত অনুমোদন দিচ্ছে স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা।

জানুয়ারি মাসে ডিএনসিসি ৩৮টি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। প্রতিটি উচ্ছেদ অভিযানে ডিএনসিসির ব্যয় অন্তত ২০ হাজার টাকা। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্মানী দিতে হয় তিন হাজার টাকা, পুলিশ, সার্ভে, পেশকার তিন দলকে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। আর আনুষঙ্গিক খরচ (শ্রমিক, খাবার, পরিবহন এবং অন্যান্য) ১৪ হাজার টাকা। জানুয়ারিতে ডিএনসিসির উচ্ছেদ করা অবকাঠামোর সংখ্যা ৩০০৪টি। এর মধ্যে অস্থায়ী অবকাঠামো ২৭৫২টি, স্থায়ী অবকাঠামো ২৫২টি। এ ছাড়া ১৫ কিলোমিটার ফুটপাত উদ্ধার এবং ৪৫ হাজার বর্গফুট জায়গা দখলমুক্ত করে ডিএনসিসি। যদিও আবার দখল হতে শুরু করেছে এসব জায়গা।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, বারবার আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা এসব এলাকায় গিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু দখলবাজরা আবারও সেখানে বসে পড়ে। এবার আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছি। আশা করি এবার উচ্ছেদের পর আর জায়গাগুলো দখল হবে না। প্রয়োজনে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। জেলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। গরিব মানুষ বলে এত দিন এটা করা হয়নি। এবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফার্মগেটের বিষয়ে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানকার বিষয়ে তিনি অবগত নন।

উদ্ধার করা জায়গা কেন বারবার দখল হয় বা কোনো কোনো স্থানে উচ্ছেদ জরুরী হলেও কেন করা হয় না, এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আসলে দ্বিপক্ষীয়। এর জন্য আইনের প্রয়োগ যেমন প্রয়োজন, তেমনি সচেতনতাও প্রয়োজন। উদ্ধার করা জায়গা কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার একটা টেকসই পরিকল্পনা থাকতে হবে এবং সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। দখলদার উচ্ছেদ করে সেখানে কিছু না করে রেখে আসা যাবে না। এর জন্য ওয়ার্ড কমিশনারসহ স্থানীয়দের নিয়ে তদারকি টিম গঠন করতে হবে। তাহলে এসব জায়গা আর বেদখল হবে না। এছাড়া ফার্মগেট, গুলিস্তান, মতিঝিলসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানের রাস্তা ও ফুটপাত যেন অবৈধ দখলদারদের কবলে না পড়ে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আরও কঠোর হবার আহবান জানান তিনি।

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, উচ্ছেদের পর হকাররা আবার ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এটা সত্যি। প্রতিদিন ঢাকা শহরে ১৪ হাজার হতদরিদ্র আসছে, যাদের ঠিকানা হচ্ছে বস্তি ও ফুটপাতগুলোতে ব্যবসা করার জন্য। চাঁদা আদায়ে কাউন্সিলররা জড়িত আছে কিনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, এখানে পুলিশরা কাউন্সিলরদের দোষ দেয় আর কাউন্সিলররা পুলিশের দোষ দেয়। তবে আমরা খুব শিগগিরই একটা বোর্ডমিটিং ডাকবো। যেখানে পুলিশ কমিশনার, ওসি ও কাউন্সিলররা থাকবেন। তবে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই সিটি করেপারেশনের উচ্ছেদ অভিযানের পরও ফুটপাত এখনো বিভিন্ন দখলদার ও হকারদের কব্জায়। ফুটপাতের ওপর তৈরি করা হয়েছে গ্যারেজ, চায়ের দোকান, ওর্য়াকশপ, বস্তিঘর, ভাঙ্গারির দোকান। আবার কোনো ফুটপাতে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির জন্য রাখা হয়েছে সরঞ্জাম, ইট, বালু, রড ইত্যাদি। কোনো ফুটপাত স্থানীয় দোকানদাররা দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করছেন। ঢাকা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের ফুটপাত পুরোটাই হকারদের দখলে। গুলিস্তান এলাকায় যে ফুটপাত আছে তা দেখে যেন বোঝারই উপায় নেই! একথা সত্যি যে, মাঝে মধ্যে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অভিযান চালানো হয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফুটপাতগুলি চলাচলের উপযোগী হয়। কিন্তু কিছু দিন না যেতেই ফের দখল হয়ে যায় উদ্ধারকৃত ফুটপাত। কেন এমনটি হয় তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারেন। ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় পথচারীদের বাধ্য হয়েই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হয়। এর ফলে পথচারীদের দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

এক তথ্য মতে, ঢাকার রাস্তায় বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার ৫৮ শতাংশই পথচারী। ফুটপাতে আবার নতুন যন্ত্রণা দেখা দিয়েছে, আর তা হলো ফুটপাতে মোটরসাইকেল। রাস্তায় যানজট বা মোড়ের সিগন্যালে লালবাতি জ¦লার সঙ্গেসঙ্গেই পথচারীকে থামিয়ে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে ফুটপাতের পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল চালকরা উঠে পড়েন ফুটপাতের ওপর। ফলে এ অবস্থায় পথচারীদের দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। যারা ফুটপাত দিয়ে হাঁটেন তাদের জন্য এটা এক চরম বিরক্তির কারণ। ২০১২ সালে হাইকোর্ট ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এসব চালকের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া মোটরযান অধ্যাদেশ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটানপুলিশঅ্যাক্ট অনুযায়ী এ ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তির জেল ও জরিমানার বিধান আছে। বাস্তবে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। পুলিশ এসব ঘটনা যেন দেখেও দেখে না! সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ফুটপাত দখলমুক্ত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পরিচ্ছন্ন সবুজ ঢাকা গড়তে উভয় সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

জানা গেছে ঢাকার ফুটপাত ঘিরে সক্রিয় তিনশতাধিক চাঁদাবাজ। এরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে লাইনম্যান হিসাবেই পরিচিত। এই লাইনম্যানরা লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দিনে ৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে। এ হিসাবে দিনে কম করে হলেও এক কোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়। ভুক্তভোগীদের একটি সূত্র জানায়, কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সন্ত্রাসীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি এসব লাইনম্যান নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ছাড়া প্রতিটি এলাকায়ই পুলিশের নামে চাঁদা তোলা হয়। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে চাঁদাবাজরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে আসে। আবার শুরু করে চাঁদাবাজি।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা এমএ কাশেম বলেন, রাজধানীতে এক লাখের বেশি হকার রয়েছে। লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। এসব চাঁদাবাজকে স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ শেল্টার দেয়। স্থানভেদে ৫০ থেকে শুরু করে ৮০, ১০০, ১৫০, ২০০ এবং ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তিনি বলেন, গড়ে ১০০ টাকা করে চাঁদা হিসাব করলেও দিনে এক কোটি টাকা চাঁদা ওঠে। আর মাসে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ৩০ কোটিতে। তার মতে, মাসে এই হিসাবের দ্বিগুণ চাঁদা আদায় হয়। চাঁদাবাজ দমন করে সরকার যদি এ টাকা নিত, তবে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধিভুক্ত ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়কের দুই পাশ মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। নিউমার্কেটের ফুটপাত দখল করে প্রতিদিনই বসছে ব্যবসায়ীরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সড়ক ও ফুটপাত দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার পরিমাণ শতাধিক। গত তিন মাসে বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ করেও জায়গাটি দখলমুক্ত রাখতে পারেনি নগর কর্তৃপক্ষ। একই অবস্থা শাহবাগমোড় এলাকায়। অবৈধ দখলের রাজত্ব হয়ে উঠেছে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকার ফুটপাত, পল্টনমোড়, গুলিস্তান দক্ষিণ সিটি নগর ভবনের বিপরীতের ফুটপাত, ফুলবাড়িয়া মোড়সহ আশপাশের এলাকা। এসব এলাকার ফুটপাত ও দখলমুক্ত রাখতে দক্ষিণ সিটির উচ্ছেদ অভিযানও নিয়মিত। কিন্তু উচ্ছেদের পর ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই আবার দখল হয়ে যাচ্ছে জায়গাগুলো।

দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন জানান, উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু উচ্ছেদের পর সার্বক্ষণিক পাহারা দেয়া তাদের জন্য কঠিন। তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক পাহারা দেয়া কঠিন।

https://dailysangram.com/post/446741