সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি দুটি বড় আকারের সমাবেশ করেছে। একটি খুলনায়, আরেকটি রাজশাহীতে। ঢাকাতে সমাবেশ করার কোনও অনুমতি এখনও তারা পায়নি। জাতীয় পর্যায়ের পরিবর্তে আঞ্চলিক পর্যায়ে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখে মনে হচ্ছে যে, এক যুগেরও বেশি সময়ের হামলা মামলা অত্যাচার নিপীড়নের পরও মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করা সম্ভব হয়নি। বলা বাহুল্য, এসব সমাবেশেও মানুষ স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। সম্মেলনের আগের দিন থেকেই রাজশাহী বিভাগে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সমাবেশে যোগ দেয়ায় বাধা সৃষ্টি করা ছাড়া ঐ সময় যানবাহন বন্ধ করে দেয়ার আর কোনও কারণ ছিল না। রাজনৈতিক সমাবেশে যোগদানের জন্য আগে মানুষকে আমন্ত্রণ জানানোর রীতি ছিল। দলে দলে যোগদানের জন্য মাইক পাবলিসিটি করা হতো। বিরাট জনসভায় যোগদানের আহ্বান সম্বলিত মাইক পাবলিসিটি এখন আর শোনা যায় না। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং পুলিশই এখন এই পাবলিসিটি করতে দেয় না। এখন আমরা পাবলিসিটির কথা ভুলেই যাচ্ছি।
এটা নিশ্চিত যে, আইন ও শাসনতন্ত্রের যে ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন বিগত নির্বাচনে আমাদের জনগণের ইচ্ছাভিত্তিক রাজনীতির প্রতিফলন ঘটেনি। আর মানুষকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করে নির্বাচন করা প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিতে নেই। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিরোধী দল বা জোট ফলপ্রসূ কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ আন্দোলন করতেও ব্যর্থ হয়েছে। এ কথা সত্য। তবে এটাও সত্য যে তারা যাতে আন্দোলন সংগ্রাম করতে না পারে তার জন্য ক্ষমতাসীন দল তার পূর্ববর্তী মেয়াদ ও নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি জামাতের প্রায় ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা দিয়ে তাদের পঙ্গু করে দিয়েছিল। ফলে দেশের রাজনীতির ময়দানে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। মানুষ স্তম্ভিতও হয়েছিল। স্বাধীনতার স্থপতির দাবিদার একটি দল মানুষকে ভোটাধিকার ও মানবাধিকার হরণ করতে পারেÑ এ কথা বিশ্বাস করতে তাদের কষ্ট হচ্ছিল।
দেরিতে হলেও দেশের বিশিষ্টজনদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নির্বাচন কমিশনকে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তাদের ইমপিচমেন্টের এই দাবি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের যে কোন গণদাবির অনুকূলে রিলে রেসের ওহনঁরষঃ কোন ব্যবস্থা না থাকায় তাদের ব্যর্থতার পর অন্য কেউ তাদের এই দাবিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আগায়ে আসেনি। অনেকে মনে করেন আমাদের শিক্ষিত লোকদের মন-মানসিকতায় ত্রুটি রয়েছে। এই ত্রুটির কারণেই এটি ঘটছে। তাদের চিন্তাধারা সুবিধাবাদী চিন্তায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন। এই সুযোগে মুষ্টিমেয় সংগঠিত স্বার্থপর লোকেরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থের বিরুদ্ধে যে কোন ক্ষতিকর কাজ করতে পারে। শিক্ষিত লোকেরা দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে তা অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অনিশ্চিত হতে বাধ্য। এই ব্যর্থ রাজনীতি থেকে অচিরে মুক্তি না পেলে আমাদের পক্ষে সুন্দরতম ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বিশদলীয় জোট এটা করতে পারতো। কিন্তু এখন এই জোটের মধ্যেই অনৈক্য বাসা বেঁধে আছে, সরকারি অপশাসনের বিরুদ্ধে তারা ঐক্য সৃষ্টি করবে কোথা থেকে। সরকার বিএনপিকে ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়। জামায়াতের সিনিয়র নেতাদের ফাঁসি দিয়ে তারা উল্লাস করছে। জামায়াত তার চার দফা কর্মসূচি থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত রেখেছে, তথাপিও সরকার কিন্তু সন্তুষ্ট নয়। তারা চায় না যে বিএনপি-জামায়াত জোটভুক্ত থাকুক। এ ব্যাপারে তারা বিএনপির উপর সওয়ার হতে পেরেছে বলে কিছু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বিএনপি নেত্রী নাকি কারামুক্তির শর্তে এতে রাজি হয়েছেন। দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়।
আমার মনে হয় একটা কথা সরকার যত শিগগির অনুধাবন করেন ততই মঙ্গল। মেরে কেটে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার নাম সরকার পরিচালনা নয়। অক্ষম নেতৃত্ব সহিংসতার তাণ্ডব বিস্তারেই সক্ষম। দ্রুতবেগে ভয়াবহ নৈরাজ্যের দিকে ধাবমান পতনকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। ঈশান কোণের কালো মেঘ ঝড়ের পূর্বাভাস। ঝড়ের আগে বাতাস স্তব্ধ থাকে। রাজনৈতিক ঝড়ের আগেও এখন রাজনৈতিক স্তব্ধতা বিরাজ করছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অর্থনৈতিক নৈরাজ্য শুরু হয়ে গেছে। ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস প্রায়। সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার পাহাড়সম অভিযোগ জমা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মুনাফাখোরীর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এখন মানুষের নাগালের বাইরে। এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগে যে চাল ১৫/১৬ টাকা ছিল, তা এখন ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নৈরাজ্য অত্যাসন্ন বলে মনে হয়। সরকার আর নৈরাজ্য সহঅবস্থান করতে পারে না।
এদিকে চলতি মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউজ তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার চর্চা এবং নাগরিক অধিকার অত্যন্ত কম। তাদের গবেষণায় রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও তার সদ্ব্যবহার, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও স্বাধীনতা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ, সরকারের কার্যকারিতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচলন, নীতি-নির্ধারণী ব্যবস্থা, ক্ষমতার ব্যবহার ও স্বচ্ছতা প্রভৃতি। অন্যদিকে নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিশ্বাস, মানবাধিকার সংস্থাসহ সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা, ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতি। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনাপূর্বক ফ্রিডম হাউস তার রিপোর্টে ‘আংশিক স্বাধীন’ দেশের তালিকার তলানীতে বাংলাদেশকে স্থান দিয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাসে এটি আমাদের জন্য চরম অমর্যাদাকর। কাজেই দেশের বিদ্যমান অবস্থা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে সরকারকে তার নীতি অবস্থান পর্যালোচনা ও পরিবর্তন করা দরকার বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে বিরোধী জোট না ভেঙ্গে তার সাথে আলোচনার টেবিলে বসে সংকট সংকুচিত করা বা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।