১৫ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১০:৫০

নির্বাসন গণতন্ত্র না নির্বাচনের?

তৃতীয় নয়ন

এত দিন বলা হতো, নির্বাচন থেকে গণতন্ত্র নির্বাসনে গেছে। অবস্থার আরো অবনতি ঘটায় এখন বলা হচ্ছে, খোদ নির্বাচনই বনবাসে গেছে। এই বন বা অরণ্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বৈরী শ্বাপদসঙ্কুল এবং তা সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের জন্য ‘অভয়ারণ্য’। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, তথা দেশের প্রধান বন্দরনগরী এবং দ্বিতীয় প্রধান শহরের সাম্প্র্রতিক মেয়র নির্বাচনের পর বাংলাদেশে উন্নয়নের দ্রুতগামী রথচক্রের নিচে পড়ে বেচারা গণতন্ত্রের সাম্প্রতিক বেহাল দশা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সে ইলেকশনের আগে শাসক দলের মেয়রপ্রার্থী পর্যন্ত বারবার বলেছেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে (প্রধান বিরোধী দলের একজন নেতা) শক্তিশালী বলতে হবে। তিনি শক্ত একজন প্রার্থী।’ সেই প্রার্থী পেলেন সর্বসাকুল্যে সাড়ে ৫২ হাজারেরও কম ভোট (তাই জামানত হারিয়েছেন)। আর ক্ষমতাসীন মহলের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৩,৬৯,২৪৮। টিভিতে ভোটের এই বিশাল পার্থক্য দেখে সচেতন, বিবেকবান, গণতন্ত্রমনা নাগরিকরা বিস্মিত হলেন বৈকি! তাদের মন্তব্য, এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল যে, মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেনি এবং অনেকেই ‘প্রাণের ভয়ে’ ভোট দিতে যাননি। অনুকূল পরিবেশ ছাড়া ভালো কাজ করা যায় না। নির্বাচনের সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ গড়ে দেয়ার মূল দায়িত্ব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের। তারা সে দায়িত্ব কতটা পালন করেছেন? এই শহুরে তামাশার ভোটাধিকারের পর কমিশনের সন্তুষ্টি : ‘ভোট সুষ্ঠু সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে।’ অতএব, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য আর মন্তব্যের দরকার হয় না।

ইদানীং কেমন নির্বাচন হবে, তা বোঝা গিয়েছিল আগেই। সরকারি দলের কোন্দলে নিহত হওয়ার মতো সন্ত্রাসই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, কী হবে ভোটের দিন। তাই ২৮ জানুয়ারির দিন বন্দরনগরে ‘ধরো মারো, সিল দাও, বাক্স ভরো’ টাইপের ঘটনাগুলো ওয়াকিবহাল নাগরিকদের অবাক করেনি। টিভি চ্যানেলগুলোর কর্তাভজা মানসিকতাও ভোটের নামে ঘটে যাওয়া প্রতারণা ও প্রহসন আড়ালে নিতে পারেনি। তাই এমন টিভির পর্দাতে দেখা গেছে, ভোটকেন্দ্রের গোপনীয়তা নেই এবং গোপন বুথ ‘ওপেন’ করে ‘বড়ভাই’রা সিল মেরে ‘সাহায্য করছেন’। আবার দেখা গেল, সবার সামনেই টেবিলের ওপর খোলা ব্যালটে প্রতীক বিশেষের ঘরে সিল মারা হচ্ছে। এর সরলার্থ, ‘আমার ভোট আমি দেবো/তোমার ভোটও আমি দেবো।’ এ দেশের রাজনৈতিক ক্যাডাররা কখন ‘হাতেম তাই’ হয়ে গেলেন? মনে পড়ে গেল, দেড় শ’ বছর আগে মধুকবি মাইকেল লিখেছিলেন, ‘অলীক কুনাট্যরঙ্গে/মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে;/নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।’ নির্বাচনী প্রহসনের উদ্ভট ট্রাজি-কমেডি এমনি এক ‘কুনাট্য’ বটে।

২০১৫ সালের চসিক মেয়র নির্বাচনে ৪৭ দশমিক ৯০ শতাংশ ভোট পড়ার পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছিল। এবার তার অর্ধেকও হয়নিÑ মাত্র ২২.৫২ শতাংশ। অতীতে এক জায়গায় বিয়ের ঘটক জানিয়েছিলেন ‘বর বাবাজির ডিগ্রিটা হলো, টিটিএমপি।’ মূর্খ কনে পরিবার তো মহাখুশি এটি শুনে। বিয়ের পর মেয়ের বাবা ঘটককে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ছেলেটার ডিগ্রি ‘টিটিএমপি’, মানে কী? এমন ডিগ্রির নাম তো আগে শুনিনি। ধুরন্ধর ঘটক সাহেব সাথে সাথে বলেছিলেন, ‘এর মানেও জানা নেই?’ টিটিএমপি মানে, ‘টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাস।’ চট্টগ্রাম সিটির ইলেকশনে এবার যে রেজাল্ট হলো, তার জন্য ‘টানাটানি’ কিভাবে কারা করেছেন, বলার দরকার পড়ে না।

একটি জাতীয় দৈনিক সে নির্বাচন প্রসঙ্গে না লিখে পারেনি, ‘ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসারের প্রায় ১৮ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এর পরও সহিংসতায় একজন নিহত হয়েছেন। প্রচারণার সময় সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আরো দুইজন।’ এই তিনটি মৃত্যু এবং রাষ্ট্রের তহবিল থেকে বিপুল ব্যয়ের বিনিময়ে যে নির্বাচন করা হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে কোন প্রবচনটি বেশি লাগসই? ‘বঙ্গারম্ভে লঘুক্রিয়া’, না ‘পর্বতের মুষিকপ্রসব’? নাকি ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’?

কিছু দিন আগে চট্টগ্রামের নির্বাচনের দিনেই কোনো কোনো পত্রিকা খবর দিয়েছিল, ক্ষমতাসীনরা যেকোনো মূল্যে জিততে চান এ নির্বাচনে। ‘যেকোনো মূল্যে’ কথাটা শুনেই অনেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কারণ এ মূল্যের মাশুল অনেক।

ভোটে অনিয়ম, কারচুপি, কেন্দ্র দখলসহ সহিংসতার ব্যাপারে সিএমপি কমিশনার বলেছেন, ‘আমরা অন্যায়ের অংশীদার না হওয়া এবং কাউকে অন্যায় করতে না দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।’ বাস্তবে তারা যে বড়জোর সাক্ষী গোপালসুলভ ‘ভালো মানুষি’ করেছেন, তার প্রমাণ স্বয়ং ওই পুলিশ কমিশনারের স্বীকারোক্তি। তার ভাষায়, ‘কাউন্সিলরদের নিয়ে শঙ্কা ছিল। তারাই আসলে সহিংসতা করেছেন।’ বলা নিষ্প্রয়োজন, এতে অন্তত আরো একজনের মৃত্যু ঘটেছে। প্রশ্ন জাগে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৮ হাজার লোক নিয়োজিত থাকার পরও ভোটের দিন এত কিছু কিভাবে ঘটতে পারে?

অনেকে ভাবতে পারেন, এত দিন পরে চাটগাঁর কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? আসলে লাভ নেই। তবে এবার পত্রিকায় দেখলাম, সেখানকার বিজয়ী মেয়র প্রার্থীসহ কয়েকজনের নামে মামলা করেছেন প্রধান বিরোধী দলের পরাজিত প্রার্থী। তাই বিলম্বে হলেও এসব কথা বলা। জানি, বলে কিছু হয় না এ দেশে। তবু কলম চালাতে হয়। যেখানে সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতি হত্যার বিচারে তদন্তকারী বদলের রেকর্ড তৈরি হয়ে গেলেও তদন্তের রেকর্ডপত্র তৈরি করা যায় না এত দিনেও, সে দেশে পত্রপত্রিকা বা মিডিয়ার মূল্য বাস্তবে কতটা, তা আন্দাজ করা সহজ।

কথা প্রসঙ্গে ইভিএম প্রসঙ্গও এসেছে। ইভিএম মানে ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। এখন অনেক ক্ষেত্রে ইভিএম যেন ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের সুবাদে ‘ইলেকট্রনিক ভেটিং মেশিন’ হয়ে গেছে। কারণ পত্রিকায় উঠেছেÑ অনেক জায়গায় ইভিএমের বোতাম টিপে দেন বিশেষ দলের ‘বড় ভাইরা’ যেন বিশেষ একটা মার্কার প্রার্থীরা জেতেন। তা হলে এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ কি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে না?
নির্বাচনের বিষয়ে বলতে গেলে বিগত ষাটের দশকে আমাদের এলাকায় পৌরসভা নির্বাচনের কথা বলতে হবে। সেটিই নির্বাচনের প্রথম স্মৃতি আমার জীবনে। তখন পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন (তদানীন্তন বিরোধী দল) আওয়ামী লীগের লোক। অথচ সবাই তাকে সমীহ করে চলতেন। আর এখন বিরোধী দলের কেউ সৌভাগ্যক্রমে জিতলেও তার দুর্ভাগ্যজনিত দুর্ভোগ অব্যাহত থাকা সুনিশ্চিত। শৈশবের ওই নির্বাচনে আমাদের ওয়ার্ডে অন্যদের সাথে একজন নেহায়েত ভালো মানুষ (যিনি সৎ ও নিরীহ) ছিলেন কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে। তাকে অযোগ্য বলার উপায় ছিল না। সে আমলে কাউন্সিলরদের বলা হতো ‘মেম্বর’; পরে তারা হয়েছিলেন ‘কমিশনার’। সে যুগেও অনেকের চোখ কপালে উঠেছিল এ কারণে যে, এত ভালো ও ভদ্রলোক কেন ইলেকশনে নামলেন? মনে হচ্ছিল, নির্বাচন ও রাজনীতি কেবল মন্দলোকের কাজ এবং কোনো জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার ভালো মানুষদের নেই! যিনি সততার জোরে জিততে চেয়েছিলেন, সেই মানুষটি ছিলেন উচ্চবংশের লোক। শুধু ন্যায়নিষ্ঠার কারণেই তিনি অর্থবিত্ত ছেড়ে ত্যাগী জীবনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আজীবন তিনি সংযম প্রমাণ করেছেন। তবে এ সমাজে তিনি একেবারে ‘বোকা’ কিংবা ‘পাগল’। যা হোক, নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছিলেন বোধহয় মাত্র ১৭টা। আর জনৈক পয়সাওয়ালা ব্যক্তি কয়েক গুণ ভোট বাগিয়ে জিতেছিলেন। সেই ইলেকশন স্মরণীয় হয়ে আছে দুই কারণে। এক. একেবারে গরিব ও অশিক্ষিত মানুষদের কেউ কেউ বলেছিলেন, আলোচ্য প্রার্থী প্রসঙ্গেÑ ‘উনি ভালো মানুষ। কিন্তু তাকে ভোট দিলে তা পচে যাবে।’ ভাবলাম, ভোট কি পচে যাবার জিনিস। তা কিভাবে সম্ভব? তবে পরবর্তীকালে এটি স্পষ্ট, যারা বিজয়ী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, তারা নিজেদের ভোট ‘পচতে না দিলেও’ বিজয়ী ব্যক্তি হয়তো তাদের ‘পচা’ই মনে করেছেন। দুই. একজন অশিক্ষিত গরিব মহিলা ভোটের দিন এলেন মায়ের কাছে। আমার মা কথায় কথায় বয়স্কা মেয়ে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভোট কেমন দিয়েছ? মহিলাটির জবাব, আপনারা কেবল ভোট দিয়েছেন। আর আমি ভোট তো দিয়েছিই; খেয়েছিও। তিনি বুঝিয়ে বললেন, মেম্বর প্রার্থী তাদের ফ্রি রিকশা সাপ্লাই দিয়েছেন কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য। এরপর ভোটের কেন্দ্রে চা-পানি, পান-সিগারেটেরও সুব্যবস্থা ছিল। অতএব, ভোট দিতে গেলে ‘খাওয়া’ও যায়।

কিছু দিন পরে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। জানা গেল, দেশটার পশ্চিমাংশে স্বৈরাচারী জেনারেল আইয়ুব খানের সমর্থন ‘বেশি’ হলেও বর্তমান বাংলাদেশ, তথা পূর্ব পাকিস্তানে বিরোধীদলীয় প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্নাহর জোর বেশি। স্মর্তব্য, বৃদ্ধা ফাতিমা ছিলেন সে সময়ের ‘জাতির পিতা’ জিন্নাহর ছোট বোন। এই মহিলা ছিলেন বিরোধী দলগুলোর জোট ‘কপ’-এর ক্যান্ডিডেট এবং এ জোটের অন্যতম নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ অঞ্চলে ভোটার অর্থাৎ মৌলিক গণতন্ত্রীদের অধিকাংশই বিরোধী দল সমর্থক। অথচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একনায়ক আইয়ুবকে ‘বিজয়ী’ দেখানো হলো। তার সাথে পরাজিত ফাতিমা জিন্নাহর ভোটের যে ব্যবধান দেখা গেল, তা ছিল অবিশ্বাস্য! অনেকর মতে, আসলে ইউনিয়ন কাউন্সিলে মৌলিক গণতন্ত্রী মেম্বর ও চেয়ারম্যানদের একটা বড় অংশই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার ক্ষমতাসীন মহল সে টাকা ছড়িয়ে আইয়ুব খানকে জেতানোর অপকর্মটা নিশ্চিত করেন। ‘মৌলিক’ গণতন্ত্রীদের ইংরেজিতে বলা হতো ‘বেসিক ডেমোক্র্যাট’। কেউ কেউ নির্বাচনী দুর্নীতি দেখে তাদের বলতে শুরু করেন, ‘বেচাকেনা ডেমোক্র্যাট’। তখন সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না এবং কেবল মৌলিক গণতন্ত্রীরাই ভোট দিতে পারতেন। তাদের কথিত গণতন্ত্রের চেহারা উন্মোচিত হয়ে যায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। মরহুম সোহরাওয়ার্দী এই বেসিক ডেমোক্র্যাসিকে বলতেন, নিম্নস্তরের শাসনব্যবস্থা।

বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে মোটামুটিভাবে ব্রিটিশ আমলের ১৯১৯ থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে আসছে। দিন দিন ভোটারের আওতা বেড়েছে, সহিংসতাও বেড়েছে। যখন ভোটার হতেন কেবল বাছাই করা কিছু লোক; তখনো নির্বাচনে সন্ত্রাস হতো। যেমন, বিগত ত্রিশের দশকের ঘটনার কথা শুনেছি। প্রায় শতবর্ষ আগের সে সময়েও অপছন্দের প্রার্থীকে নমিনেশন পেপার জমা দিতে না দেয়ার জন্য বাধা প্রদান কিংবা ভোটের দিন বৈরী প্রার্থীকে আটকে রাখার মতো অন্যায় করা হতো। এভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ প্রভাব বিস্তার করতেন। তবে এসব অঘটনের সংখ্যা ছিল খুব কম। আর এখন এ ধরনের অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে গেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/569517