১৫ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১০:৪৬

পঙ্গুত্বের অন্ধকারে হাজারো জীবন

যে পা দিয়ে ইব্রাহিম রিকশায় পেডাল মারতেন, সেই পা এখন আর চলে না। কর্মক্ষমতা হারিয়ে রিকশার চাকার মতো বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর সংসারের চাকা। দুই শিশুসহ চারজনের পরিবার নিয়ে কোনো রকমে দিন কাটে তাঁর। দুই সন্তানের খাবারের জন্য অন্যের ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কেউ এক মুঠো ভাত দিলে কোমলমতি শিশুদের মুখে দিতে পারেন, না পেলে অনাহারে থাকে। বলছি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ইব্রাহিম খলিলের কথা। গেল বছর সড়কে রিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা হারান তিনি।

kalerkanthoপটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর জসিম প্যাদার জীবনও সুখে-দুঃখে কেটেই যাচ্ছিল। একটি সড়ক দুর্ঘটনা যেন সব এলোমেলো করে দিল। টমটম চালানো যে জসিম একদিন ছিলেন সংসারের কর্তা, সেই জসিমই আজ বোঝা। এখন স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে মানবেতর জীবন কাটছে তাঁর। গল্পটা যেন কুড়িগ্রামের দুলু মিয়ার ক্ষেত্রেও প্রায় একই। ৪৭ জন যাত্রীর প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজেই পঙ্গু হয়ে গেছেন। ১৩ বছর ধরে ক্রাচে ভর দিয়ে চলছে জীবন। দুর্ঘটনার পর তিনি কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। পুরোপুরি সুস্থ হতে পায়ে হাড় সংযোজন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দুই লাখ টাকা, তাও জোগাড় হয়নি। চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারানো দুলু মিয়া এখন কুড়িগ্রাম শহরের কলেজ মোড়ের ফুটপাতে একটি পান দোকান দিয়ে সংসার ও চিকিৎসার খরচ জোগাড় করছেন। থাকেন বস্তির একটি জীর্ণ ঘরে।

শুধু এই তিনজনই নন, প্রতিদিনই দেশে এমনভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে শত শত মানুষ। বেঁচে থাকলেও তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পঙ্গু দিবস।

জাতীয় অর্থপেডিক্স হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেহেতু অনেক কারণেই মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেন; তাই ঠিক আলাদা করে এর কোনো হিসাব দেশে এখনো নেই। আবার পঙ্গুত্বের ধরনেও শ্রেণিবিন্যাস আছে। তবে দেশে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি মানুষকে পঙ্গু হতে হয় সড়ক দুর্ঘটনার কারণে।’ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে সড়কে প্রাণ গেছে ১৪ হাজার ৬৩৫ জনের, এর বিপরীতে আহত হয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৩ জন। তবে এই আহতদের মধ্যে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন কতজন, সেই হিসাব নেই সংগঠনটির কাছে। উল্টোদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলছেন, ‘আমরা তো বহুদূর, সরকারের কাছেই এর কোনো হিসাব নেই।’

নিসচার প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে চার হাজার ৯২টি দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৮৫ জন লোক আহত হয়। ২০১৯ সালে চার হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় ছয় হাজার ৯৫৩ জন। এক বছরের ব্যবধানে আহতের সংখ্যা ২৪ শতাংশ কমেছে। তবে অনেক ছোট ছোট দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয় বলে তা পত্রিকায়ও প্রকাশ হয় না। এদের মধ্যে অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন, যা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।

এদিকে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৫৬ নম্বর ধারায় দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষেত্রমতে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারকে আর্থিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। তবে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই নতুন আইনটি (সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮) পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। হলে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের উপকার হতো। আইনে এটি যুক্ত করতে আমাদের বহু সময় লেগেছে। সরকারকে বলেও কাজ হচ্ছে। মূলত আন্দোলন ছাড়া কোনো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। এই নতুন আইনটিও কলেজের ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে হয়েছে। যাঁরা আহত হয়ে মারা গেছেন বা পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে আমার ডাকে আন্দোলনে নামতে হবে।’

সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ইব্রাহিম, জসিম আর দুলু মিয়ার সংখ্যা কত, তা জানা নেই কারো। সড়কে দুর্ঘটনায় নিহতের খবর কিছুটা চোখে পড়লেও আহতদের যেন তেমন কোনো খবর নেই। আর এই আহতদের মধ্যে একটা সংখ্যা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে। আবার সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরছে অনেকে। কিন্তু যারা মরণ যন্ত্রণা সঙ্গী করে পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফিরছে, তাদের ভোগান্তি আজীবনের।

যারা আহত হচ্ছে তাদের জন্য আপনার সংগঠন কিছু করছে কি না—জানতে চাইলে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা পাই। এটা শুরু করেছিলাম আমার নিজের অর্থায়নে। পরে ২০১৬ সালে এনজিও করতে হয়েছে, নইলে জাতিসংঘের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যেত না। আমাদের এত সামর্থ্য নেই। তবে সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে হলে আন্দোলন করতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/03/15/1014179