১৫ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১০:৪৪

বিপদ সংকেত

করোনার সংক্রমণ ফের দ্রুতগতিতে বাড়ছে। দু’মাসের মধ্যে গতকাল ছিল সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। রাজধানীর করোনার নির্ধারিত কিছু হাসপাতালে আইসিইউ’র আসন মিলছে না। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, আবার বড় কোনো ধাক্কা আসতে পারে সামনে। বর্তমান অবস্থা একটা বিপদ সংকেত।

বর্তমান পরিস্থিতি তারই লক্ষণ। এবার বয়স্কদের সঙ্গে তরুণরাও বেশ আসছেন হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, করোনার স্বাস্থ্যবিধি না মানলে দেশ বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে। নতুন করে এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই তরুণ, তাদের বেশির ভাগেরই আইসিইউ লাগছে। চলমান করোনা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হওয়ায় আবারো কঠোর স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে সরকার।

এদিকে, গতকাল শ্যামলীতে টিবি হাসপাতালে ওয়ান স্টপ টিবি সেন্টারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনের দিনে দেশ বড় বিপদে পড়বে। তিনি বলেন, গেল দুই মাস আমরা স্বস্তিতে ছিলাম, তাই এখন আমরা কোনো কিছু মানছি না। সামনের দিকে আমরা আরো বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছি, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন, নতুন করে এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই তরুণ, তাদের বেশির ভাগেরই আইসিইউ লাগছে। চলমান করোনা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হওয়ায় আবারো কঠোর স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশনা দিতে যাচ্ছে সরকার।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় দেশের সমস্ত হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনসহ সিভিল সার্জন অফিসগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সারা দেশে আইসিইউগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। গতকাল সিভিল সার্জনদের এই বিষয়ে নতুন নির্দেশনা দেয়ার কথা বলেন ডিজি।

মহাপরিচালক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি জোরদার করতে এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইউকে ও আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন ধরনের কারণে দেশে সংক্রমণ বাড়ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিগগিরই টিকার তৃতীয় চালান দেশে আসবে বলে জানান তিনি। স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি আরো বলেন, টিকা নেয়া মানে স্বাস্থবিধি না মানা নয়। কারণ, প্রথম ডোজ নেয়ার পর প্রতিরোধ ক্ষমতা সেভাবে তৈরি হয় না। আবার দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পরও প্রতিরোধ ক্ষমতা কতোদিন থাকবে তাও কেউ জানেন না। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই।

অন্যদিকে, করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ প্রধান ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম তার এক ফেইজ বুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, কোভিড পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। মাস দুয়েক একটু শ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। কখনো একটা বেডও খালি রাখতে না পারলেও রোগীদের ওয়ার্ডে শিফট করা যাচ্ছিল। মৃত্যুহার অনেক কম ছিল। এক সপ্তাহের মাঝে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। আক্ষরিকভাবে রোগীদের বাঁচিয়ে রাখতে আমরা এখন যুদ্ধ করছি এবং হেরে যাচ্ছি বারবার। এই পরিবর্তন আমরা আমাদের চোখের সামনে ঘটতে দেখছি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের কথায় আপনারা বিরক্ত হন জানি, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই, আমরা বারবার বলে যাই। কেউ না শুনলেও, সবাই মুচকি হাসলেও আমাদের বলে যেতে হবে। একটুখানি শ্বাস বুকের ভেতরে নেয়ার জন্য মানুষের তীব্র কষ্টটা আপনারা কেউ পাশে দাঁড়িয়ে দেখেন না, শেষ সময়ের কষ্টটা কি তীব্র! আমার তেমন কোনো শত্রু নেই, থাকলেও আমি তার এমন মৃত্যু চাইতাম না।

এই চিকিৎসক বলেন, এর বিস্তার বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায় না। যেই পরিবারের কেউ এর মাঝ দিয়ে যায় শুধু তারা জানেন।
হয়তো আমরা আরেকটি ওয়েভের শুরুর পথে। এই সময়ে রোগীরা দ্রুত খারাপ হচ্ছেন। মনে রাখবেন, এখনো কোভিডের কোনো চিকিৎসা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। তাই এর প্রতিরোধই একমাত্র পথ। আমাদের ফোন আবার ব্যস্ত হয়ে গেছে চেনা অচেনা মানুষের কলে। খুব কষ্ট হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের কিছু করার থাকে না। বিশ্বাস করুন, আমাদের একমাত্র চাওয়া সবাই ভালো থাকুন। কার্ভের শুরুতে যদি এই অবস্থা থাকে তবে এর পিকে আমরাই বা কেমন থাকবো।

তিনি তার ফেইজ বুক পোস্টে অনুরোধ করে আরো জানান, সকল সামাজিক জমায়েত থেকে অসামাজিকভাবে দূরে থাকুন। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিরাপদ রাখুন (তবে এটাও মনে রাখবেন এবার আমরা প্রচুর তরুণ রোগীও পাচ্ছি)। গত বছর মার্চ মাসে যে সকল সাবধানতা পালন করেছিলেন সেগুলোই একইভাবে পালন করুন, রিলিজিয়াসলি। মাস্ক নিজে পরুন, অন্যকে পরতে বাধ্য করুন। প্রয়োজনে সিন ক্রিয়েট করুন। হাত সাবান দিয়ে বারবার ধুয়ে নিন। না পারলে স্যানিটাইজ করুন। এই মুহূর্ত থেকে অপ্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হওয়া একদম বন্ধ করে দিন। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয় আর হৃদয় প্রসারিত করতে হয়। পরম করুণাময় সবাইকে নিরাপদ রাখুন।

ওই চিকিৎসকের মতো আরো বেশ কয়েকজন চিকিৎসক সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এই সময়ে পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত, আরো ১৮ জনের মৃত্যু: দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলছে। করোনার শনাক্তের হার ৭-এর উপরে। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ৭ জনের বেশি করোনা রোগী ধরা পড়ছে দেশে। আড়াই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত। দেশে করোনা শনাক্তের এক বছরের মাথায় দুই মাসের ব্যবধানে গত বুধবার আবারো হাজারের ঘরে পৌঁছায় শনাক্ত। এরপর থেকে শনাক্ত শুধুই বাড়ছেই। সঙ্গে ফের মৃত্যুও ঊর্ধ্বমুখী। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ১৫৯ জন। এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১৮ জন এবং এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৮ হাজার ৫৪৫ জন।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ৩৮৫ জন, এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ১১ হাজার ৬৯৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৫২৮টি, অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৬ হাজার ২০৬টি। এখন পর্যন্ত ৪২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১২ জন পুরুষ এবং নারী ৬ জন।
স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফল-অধ্যাপক আব্দুল্লাহ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেছেন স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যা হয় তাই হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে যেকোনো রোগ ছড়ায় বেশি। আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যেহেতু করোনার নতুন ধারা আরো দ্রুত ছড়ায়। আমাদের স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছে না এটাই সমস্যা। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সচেতন হতে হবে, সরকারকেও ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। মানবজমিনকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যারা এখনো টিকা নেয়নি আমি বলবো তাদের টিকা নিয়ে নেয়া উচিত। যাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতা আছে তারা ছাড়া সবাই যেন টিকা পায় সেটার ব্যবস্থা করাও দরকার।

নিবন্ধন প্রায় ৫৭ লাখ, টিকাগ্রহীতা প্রায় ৪৪ লাখ: একদিকে সারা দেশে গণটিকাদান কর্মসূচির এক মাস পূর্ণ হয়েছে। গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর গতকাল ৩০তম দিনে ভ্যাকসিন নিয়েছেন ৯৫ হাজার ৬৭৫ জন। প্রতিদিনই টিকা নেয়ার সংখ্যা কমছে। এর মধ্যে ঢাকায় নিয়েছেন ১৬ হাজার ৮২৫ জন। এ পর্যন্ত দেশে মোট টিকা নিয়েছেন ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৭ লাখ ৯৪ হাজার ১১১ জন এবং নারী ১৬ লাখ ৩ হাজার ৯৮৩ জন। টিকা নেয়ার পর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে মোট ৮৮৯ জনের। অন্যদিকে গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা নিতে অনলাইনে মোট নিবন্ধন করেছেন ৫৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৪৩ জন।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=266294&cat=2