১৫ মার্চ ২০২১, সোমবার, ৭:৩৫

তথ্য গোপনের কারণেই দেশে আবার করোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে

ইবরাহীম খলিল : যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন যে ধরণটি (স্ট্রেইন) তা জানুয়ারি মাসেই বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। কিন্তু জানুয়ারিতে পাওয়া গেলেও, সে তথ্য জানা যাচ্ছে এখন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেছেন, জানুয়ারির শুরুতেই যুক্তরাজ্য ফেরত যাত্রীদের মধ্য থেকে প্রথম এই ধরণ শনাক্ত হয়। প্রথম যে যাত্রীর শরীরে এই নতুন ধরন শনাক্ত হয়, তিনি যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে তার শরীর থেকে সংগ্রহকৃত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে আইইডিসিআর করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্যের নতুন ধরণ শনাক্ত করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুই মাস পর এই খবর জানানো উচিত হয়নি। তথ্য গোপন করার কারণে দেশে করোনা বৃদ্ধি পেয়ে থাকতে পারে।

জানুয়ারির শুরুতে ভাইরাসের যুক্তরাজ্যের নতুন ধরন শনাক্ত হলেও, সেটি আগে কেন জানানো হয়নি, সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক শিরিন বলেছেন, জানুয়ারির শুরুতে ঢাকায় প্রথম শরীরে করোনাভাইরাসের নতুন ধরণবাহী একজন শনাক্ত হন। এরপর সিলেটে ওসমানী বিমানবন্দরে নামা যাত্রীদের মধ্য থেকেও ভাইরাসের নতুন ধরণবাহী ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন।

তিনি বলেছেন, কম্যুনিটি ট্রান্সমিশন ঠেকাতে শনাক্ত ব্যক্তিদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা হয়েছে, এবং এখনো তারা আইইডিসিআরের নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক অবস্থারও নিয়মিত খোঁজ রাখছে আইইডিসিআর। যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকেই দেশটি থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের ব্যাপারে নানা সতর্কতা নেয়া হয়। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকেই যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে সতর্কতার অংশ হিসেবে অনেক দেশ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করলেও, বাংলাদেশ তা করেনি।

বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ ১৭টি নতুন জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা করে পাঁচটিতেই করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন পায়। সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিম খান সেসময় বিবিসিকে বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া নতুন স্ট্রেইনের যে বৈশিষ্ট্য, তার সাথে বাংলাদেশে পাওয়া ভাইরাসের পুরোপুরি মিল না থাকলেও অনেকটা মিল রয়েছে। এ নিয়ে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন যে ধরণ পাওয়া গেছে, সেটি আগের স্ট্রেইনের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি গতিতে ছড়ায় বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। বাংলাদেশে সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

গতকাল রোববার দুইমাসের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ মানুষ করোনায় মারা যায়। সেইসঙ্গে শনাক্ত হয় হাজারের বেশি। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য বিধি না মানা হলে সামনে বিপদ। তার মানে সামনে আরও বেশি মৃত্যুর আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য খাতের এই অবিভাবক।

স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইন দ্রুত ছড়ায়। দুই মাসের বেশি সময় আগে শনাক্ত হয়েছে, এর কারণে দেশে সংক্রমণ বাড়তে পারে। আবার রেসপিরেটরি রুটে একটা ভাইরাস ঢুকলে অন্য ভাইরাসকে ঢুকতে দেয় না। শীতকালে আমাদের সর্দি-কাশির মতো অন্যান্য ভাইরাস খুব বেশি সংক্রমিত হয়েছিল। এসব দেশি ভাইরাস ঢুকার ফলে হয়তো করোনাভাইরাস ঢুকার সুযোগ পায়নি। সে কারণে হয়তো শীতকালে সংক্রমণ কমে গিয়েছিল। এখন শীতকালের ভাইরাসগুলো কমে গেছে, করোনাভাইরাস সুযোগ পেয়ে গেছে। সে কারণেও বাড়তে পারে। তবে বাড়লেও তা ১০ শতাংশের বেশি বাড়ার সম্ভাবনা কম।

গতকাল রোববার করোনা বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বর্তমান সময়ে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘অনেকে সন্দেহ করছে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের কারণে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওই ভ্যারিয়েন্ট সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে আগের ভ্যারিয়েন্টকে রিপ্লেস করে- এটা এত তাড়াতাড়ি সম্ভব না। সুতরাং এই একটা জিনিস দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আরও অন্য ফ্যাক্টর থাকতে পারে।

তিনি বলেন, ‘শীতকালে আমাদের অন্যান্য ভাইরাস খুব বেশি সংক্রমিত হয়েছিল- সর্দি, কাশি, জ্বরজারিতে। রেসপিরেটরি রুটে যদি একটা ভাইরাস ঢুকে যায়, অন্য ভাইরাসকে ঢুকতে দেয় না। দেশি ভাইরাস ঢুকার ফলে হয়তো করোনাভাইরাস ঢুকার সুযোগ পায়নি। সে কারণে হয়তো শীতকালে সংক্রমণ কমে গিয়েছিল। এখন গ্রীষ্মকাল আসছে, শীতকালের ভাইরাসগুলো কমে গেছে। এখন আবার করোনাভাইরাস সুযোগ পেয়ে গেছে। আবার সংক্রমণ বাড়ছে। তবে খুব বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না, এটা আমাদের ধারণা। বলছি না যে, এটা সত্য, প্রমাণিত। আমার ধারণা, এই সংক্রমণ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। তারপর ওইভাবেই থাকবে। গত বছর যেমন ২০, ২২ এমনকি ৩১ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছিল; ওই রকম হবে না।’

ড. বিজন কুমার শীল বলেন, ভাইরাসটা যদি দুই মাস আগে পাওয়াই গিয়ে থাকে, তাহলে দেরি করা উচিত হয়নি। আমি যতটুকু শুনেছি, ৫ জানুয়ারি শনাক্ত করা হয়েছিল। তারা হয়তো বলেনি বা উপেক্ষা করে গেছে। এখন দেখার বিষয়- যারা যুক্তরাজ্যের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা আগে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি-না কিংবা কোনো টিকা নেয়া মানুষের মধ্যে এই রোগ দেখা যাচ্ছে কি-না। করোনায় আক্রান্ত মানুষ যদি আবার যুক্তরাজ্যের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন কিংবা টিকা নেয়া মানুষ যদি যুক্তরাজ্যের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে কিন্তু বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।

বাধ্যতামূলক মাস্ক বা স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করে তাহলে হয়তোবা আটকানো যাবে বলেও মনে করেন ড. বিজন। নবম সপ্তাহের (২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ) সঙ্গে দশম সপ্তাহের (৭ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ) তুলনায় ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা, ৬৭ দশমিক ২৭ শতাংশ নতুন রোগী শনাক্ত, ৪২ দশমিক ৪১ শতাংশ সুস্থতা এবং ৪৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে।

নতুন আক্রান্তদের আইসিইউ বেশি লাগছে বলে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলম। তিনি বলেন,‘নতুন করে এখন যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই তরুণ, তাদের বেশিরভাগেরই আইসিইউ লাগছে। তিনি বলেন, ‘গেলো দুই মাস আমরা স্বস্তিতে ছিলাম, তাই এখন আমরা কোনও কিছু মানছি না। সামনের দিকে আরও বড় ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছি, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় দেশের সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরইমধ্যে প্রশাসনসহ সিভিল সার্জন অফিসগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সারা দেশে আইসিইউগুলো প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/569517