১৪ মার্চ ২০২১, রবিবার, ১:১৩

সুবর্ণজয়ন্তীতে জামায়াতের মুক্তিযোদ্ধা বান্ধব কর্মসূচি : সেখানেও বাগড়া দিচ্ছেন ওরা?

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল। এটি বাংলাদেশের সংবিধান সম্মত একটি রাজনৈতিক দল। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি সংগত বাধা নিষেধ সাপেক্ষ সমিতি বা সংঘ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে:

তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি
(ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।
(খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠি, নারী, পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গঠিত হয়।
(গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জংগী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা
(ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।

সংবিধানের ৩৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।

৩৯ নং অনুচ্ছেদে কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
ওপরে বাংলাদেশ সংবিধানের যে কয়টি অনুচ্ছেদের উল্লেখ করলাম এগুলো মোটামুটি সকলের জানা। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারা তো এগুলো জানেনই। যারা রাজনীতি করেন, যারা সাংবাদিকতা করেন তারা এগুলো অবশ্যই জানেন বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর থেকে অথবা আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এসব অনুচ্ছেদ বা সংবিধানের ১৫৩ টি অনুচ্ছেদের একটি অনুচ্ছেদও লঙ্ঘন করে নাই।

আজ যারা বাংলাদেশ জামায়াতের সদস্য বা কর্মকর্তা তাদের মধ্যে যাদের বয়স ৫০, তাদের পক্ষে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র বা বাংলাদেশের সংবিধানের বিরোধিতা করার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ বাংলাদেশের জন্মের সময় তাদের অনেকের জন্মই হয় নাই। অথবা হলেও তারা সদ্য মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ হয়েছেন। যাদের বয়স ৬০, তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তখন তাদের বয়স মাত্র ১০। এমনকি যাদের বয়স ৬৫ তাদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ ১৫ বছরের কৈশর উত্তীর্ণ বালক বা তরুণ রাষ্ট্র বা সংবিধান বিরোধিতার লায়েকই হয় না।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্ষেত্রে একথা শতভাগ নয়, হাজার ভাগ প্রযোজ্য। কারণ শিবিরের সদস্য ও কর্মীদের সর্বোচ্চ বয়স ৩০। অর্থাৎ বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার বা স্বাধীন হওয়ার ২০, ২৫ বা ৩০ বছর পর তারা জন্ম নিয়েছে। এরা কিভাবে রাষ্ট্রবিরোধী হবে? এরা কিভাবে সংবিধান বিরোধী হবে? কিন্তু তার পরেও তাদেরকে নিছক গায়ের জোরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বনামে সংগঠন করার অধিকার দেওয়া হচ্ছে না।

॥ দুই ॥
এসব কথা বললাম গত ১০ মার্চ ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’ প্রকাশিত একটি কমেনটেটিভ রিপোর্ট বা মন্তব্য প্রতিবেদন দেখে। রিপোর্টটির শিরোনাম, “ক্ষমা না চেয়েও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন জামায়াতের!” সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপনের কথা বলতে গিয়ে রিপোর্টটির তৃতীয় লাইনে বলা হয়েছে, “স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোও নানা কর্মসূচি ইতোমধ্যে পালন করতে শুরু করেছে।” কারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি? বিএনপি কি স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি? খেলাফত মজলিশ বা খেলাফত আন্দোলন কি বিপক্ষ শক্তি? চরমোনাইয়ের হুজুরদের দল ইসলামী আন্দোলন কি বিপক্ষ শক্তি? গণ ফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য- এসব দল? এরা কি বিপক্ষ শক্তি? এসব প্রশ্ন জামায়াতের নয়। এসব প্রশ্ন বিএনপি বা অন্যদের।

আর সুবর্ণ জয়ন্তী পালন? জামায়াতের প্রতিটি কর্মী এবং প্রতিটি সদস্য জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক। তারা সকলে বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক। বাংলাদেশে কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ কাউকে দেশ প্রেমের সোল এজেন্সী দেয়নি। রিপোর্টটি দেখে মনে হয় যে তারা দেশ প্রেমের মনোপলি কন্ট্রোল নিয়েছে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা শিবির যে দলেরই হোক না কেন, যে যুবকটি জন্ম নেওয়ার পর চোখ মেলেই দেখেছে বাংলাদেশ, তার মাথায় দেশ প্রেমের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো দেশ আসবে কোত্থেকে?

আর যিনি ৫০ বছরের পৌঢ় তিনিও যৌবন প্রাপ্তির পর গেয়ে উঠেছেন:
প্রথম বাংলাদেশ আমার
শেষ বাংলাদেশ
জীবন বাংলাদেশ আমার
মরণ বাংলাদেশ
বাংলাদেশ। বাংলাদেশ। বাংলাদেশ।

যারা দেশে জনগণের মধ্যে বিভাজন চান না, যারা চান জাতীয় ঐক্য, তারা যখন জেনে গেছেন যে জামায়াত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন করছে তখনতো তাদের কিন্তু আনন্দে উদ্বেল হওয়ার কথা। তা না হয়ে তাদের গাত্রদাহ হয় কেন? জামায়াত কি নিষিদ্ধ কোনো দল? ঐ রিপোর্টেই তো বলা হয়েছে যে গণজাগরণ মঞ্চ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য ‘বহু বছর ধরে দাবি জানাচ্ছে’। কেন নিষিদ্ধ হয়নি? সেই উত্তরও তো এই রিপোর্টেই দেওয়া আছে।

॥ তিন ॥
ইত্তেফাকের এই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমান ১০ দফা কর্মসূচি দিয়েছেন। এই ১০ দফা কর্মসূচিও রিপোর্টটিতে বিধৃত হয়েছে। এখন ইত্তেফাক বলুক যে ঐ ১০ দফা কর্মসূচির কোন দফাটি স্বাধীনতা বিরোধী? অথবা গণ বিরোধী? নাকি ঐ ১০ দফা গণমুখী এবং সেখানে রয়েছে দেশপ্রেমিকতার জ্বলন্ত স্বাক্ষর?

ঐ ১০ দফার মধ্যে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার প্রদান এবং অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহ সংস্কার ও নির্মাণে সহযোগিতা করা; অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, সন্তানদের শিক্ষা উপকরণ প্রদান, মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের সহায়তা, রোগীর সহায়তা, করোনায় মৃত্যু বরণকারীদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, কন্যা দায় গ্রস্থদের বিয়ে এবং আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা প্রদান, অসহায়, এতিম, পথশিশু ও দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচি, স্বাধীনতায় জীবন দানকারীদের জন্য ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের হেফাজতের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করা।

দৈনিক ইত্তেফাককে বলছি, আপনারা বলুন, ওপরে যেসব কর্মসূচির উল্লেখ রয়েছে তার কোনটি স্বাধীনতা বিরোধী? কোনটা গণ বিরোধী? এমন গণমূখী, জনকল্যাণমূলক এবং দরিদ্র বান্ধব কর্মসূচি আর কোনো দল নিয়েছে? গরীব, দুস্থ, অসহায় এবং অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি আর কোনো দল কি দিয়েছে? স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন দানকারীদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করার মত মহান কর্মসূচি আর অন্য কোনো দল কি দিয়েছে? এসব কর্মসূচিতেও আপনাদের গাত্রদাহ? এর চেয়েও যদি উন্নতর ও মহত্বর কোনো কর্মসূচি থাকে, তবে আপনারাই সেটি বলুন। আর দেখুন জামায়াত সেই ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে কি না। তাই বলে এমন কিছু বলবেন না যেটা মানুষের সাধ্যের বাইরে।

সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমান যে বক্তব্য রেখেছেন সেই বক্তব্যে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন চার জাতীয় নেতাকে। এরা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী।

বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য জামায়াত প্রধান যে উদার ও উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন তারপর আর কোনো কথা থাকতে পারেনা। তিনি বলেছেন, “স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের শপথ হবে, বিভেদ নয়, ঐক্যের মাধ্যমে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। তাই ক্ষমতাসীন সহ সকল রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রতি আমাদের আহ্বান, আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশের বৃহত্তর কল্যাণে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা করি। হিংসা-বিদ্বেষ, হানা হানি ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধ হই। সুখী সমৃদ্ধশালী ইনসাফপূর্ণ বাংলাদেশ গঠনে হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাই।”

এটুকু আগেই বলেছি যে এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। সহযোগী বন্ধুরা ভুলে যাচ্ছেন কেন যে জামায়াত কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়। নিবন্ধন বাতিল অর্থ শুধুমাত্র স্বনামে নির্বাচন করা থেকে বিরত রাখা, রাজনৈতিক তৎপরতা বা কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা নয়। সন্ত্রাস নিয়ে দেশে অনেক কথা হয়েছে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে, দন্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সরকারের ১২ বছরের শাসনকালে একজন জামায়াত নেতাকর্মীকে দন্ড দেওয়া তো দূরের কথা, সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করাও যায়নি, প্রমাণ করা যায়নি। কারণ জামায়াত ও শিবির সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে বিশ্বাস করে না। জামায়াত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। অযথা খোঁচাখুঁচি করে লাভ কি? কোনোরূপ উস্কানীর ফাঁদে জামায়াত পা দেবে না।
Email: asifarsalan15@gmail.com

 

https://dailysangram.com/post/446537