১৪ মার্চ ২০২১, রবিবার, ১:০৩

রেন্টাল কুইক রেন্টালে বিদ্যুৎ খাতে বোঝা বাড়ছেই

রেন্টাল কুইক রেন্টালে বিদ্যুতে বোঝা বাড়ছেই। তবে আশার বিষয় হলো এ যুগের অবসান হতে যাচ্ছে ২০২৪ সালে। গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। ফলে ভর্তুকির টাকা গেছে ব্যবসায়ীদের অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে। আর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার বাকি অর্থের সমন্বয় করেছে। গত ১০ বছরে সরকার সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। ভোক্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ চাই না রেন্টাল কুইক রেন্টাল বন্ধ করা দরকার।

২০১৩ সালের পর দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (কুইক রেন্টাল) থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি ছিল সরকারের। কিন্তু বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে না আসায় কুইক রেন্টালের মেয়াদ বাড়ানো হয় পাঁচ বছর। তবে ২০১৮ সালের পর কুইক রেন্টাল আর থাকবে না, এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় সে সময়। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছেই।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৬১ পয়সা। বর্তমানে ব্যয় ৬ টাকা ২৫ পয়সা। এমনকি বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি (গ্যাসভিত্তিক) কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ব্যয়ও গড়ে ২ টাকা। আর তেলচালিত কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ১৬-১৭ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিলেও তা হওয়া উচিত ছিল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, দরপত্রে। এতে যে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দিত, তাকেই কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল। এতে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যেত। সরকার এসব ব্যবস্থা রাখেনি। ফলে শুধু কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে বহুগুণ বেশি।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে ৬১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়েছে। এই একই সময় ২ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৪ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। ফলে ভর্তুকির টাকা গেছে ব্যবসায়ীদের অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে। নতুন সংশোধিত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে ২৪ হাজার, ২০৩০ সালে ৪০ হাজার ও ২০৪০ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে ভরা গ্রীষ্মে বিদ্যুতের গড় চাহিদা দিন–রাত মিলিয়ে আট থেকে নয় হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সরকারের হাতে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে সেটি ২৪ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছালে চাহিদা সে তুলনায় বাড়বে না।

বিদ্যুৎ ঘাটতি সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে ২০০৯ সালের দিকে ভাড়ায় (রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল) বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করে সরকার। বর্তমানে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু আছে ১৬টি, যার মোট সক্ষমতা ১ হাজার ১০৯ মেগাওয়াট। তিন থেকে ১৫ বছরের জন্য চালু করা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৪ সালে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চাইছে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর বৃদ্ধি না করা হোক। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি সুপারিশও করেছে সংসদীয় কমিটি।

প্রধানত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি পূরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদেই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বারস্থ হয়েছিল সরকার। বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার অভাব ও ঘাটতিজনিত ওই সমস্যার অনেকটাই এখন সমাধান হয়েছে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসছে। উৎপাদনে না আসা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও দ্রুত চালু করতে চাইছেন নীতিনির্ধারকরা। অন্যদিকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় অনেক বেশি। এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে চালুকৃত এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আর না বাড়ানোই উত্তম বলে মনে করছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।

এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, যত তাড়াতাড়ি এসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া যায়, তত আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। আমরা জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাই। এজন্য স্বল্পমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনো সমাধান নয়। সেজন্য মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, সেগুলো যাতে দ্রুত উৎপাদনে আসে, সে বিষয়ে তদারকি বাড়ানোর জন্য কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এজন্য কমিটির বৈঠকে ২০২৪ সালের মধ্যে সবগুলো কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিটির এ সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির প্রয়োজনীয়তাও কমে আসবে। এতে সরকারের ব্যয় সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রধান ক্রেতা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) লোকসান কমে আসবে। কারণ বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিপিডিবিকে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। এ বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে ক্রমেই আর্থিক সক্ষমতা হারাচ্ছে বিপিডিবি। প্রতি বছরই সংস্থাটির লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদই চলে যাচ্ছে পরিচালন ব্যয়ের সিংহভাগ। তথ্যমতে, সংস্থাটির মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ যাচ্ছে বেসরকারি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ।

কমিটির গতকালের বৈঠকে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ ঘাটতিজনিত কারণে ও দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। তাৎক্ষণিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিন বছর, পাঁচ বছর ও ১৫ বছরের জন্য ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ পর্যন্ত ছয়টি রেন্টাল ও ছয়টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এ ১২ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৮৩৩ মেগাওয়াট।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্রমান্বয়ে অবসর দেয়া হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় হেভি ফুয়েল অয়েলভিত্তিক (এইচএফও) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। তবে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রাখতে কম ব্যয়বহুল কিছু গ্যাসভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বৃদ্ধি করা হচ্ছে।

বর্তমানে ১৬টি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ৩৫২ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক নয়টির উৎপাদন সক্ষমতা ৭৫৭ মেগাওয়াট।

https://dailysangram.com/post/446545