১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৬:০৩

সীমান্ত হত্যা চলছে চলবে

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: সর্বশেষ ফেনী নদীর ওপর নৌ-সেতু বানিয়ে ভারতকে কানেকটিভিটি দিয়েছি। তার আগে সড়কপথে-রেলপথে-নৌপথে ভারতকে কানেকটিভিটি দিয়ে আমরা বগল বাজিয়েছি। কী মজা! ভারতকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অবাধে কার্যত বিনা ভাড়ায় কানেকটিভিটি দিয়েছি। একবার অবশ্য আমরা বলেছিলাম যে, ভারতকে যা দিয়েছি, তা তাদের সারাজীবন মনে রাখতে হবে। না, মনে রাখেনি ভারত। বারবার কথা দিয়েও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করেনি। তিস্তা শুকনো মওসুমে মরুভূমিতে পরিণত হয়। এখানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আপত্তির ধুয়া তোলে মমতা রাজি নয়। এবার পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জিকে হারাতে পারলে তিস্তার পানি পাওয়া যাবে। আর হারাতে না পারলে যে তিমিরে আছি সে তিমিরেই থাকব।

তার চেয়েও বড় সমস্যা সীমান্ত হত্যা। পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। এই সীমান্তের কাছাকাছি গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাংলাদেশিদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। তারা তার নানা ধরনের যৌক্তিকতাও দাঁড় করায়। আবার বাংলাদেশের কিছু সেবাদাস কর্মকর্তা তাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলে, যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা সীমান্তে অপরাধ করেছিল। অপরাধের শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড? মৃত্যুদণ্ড হতে হলে ভারতীয় আইনেও বিচারের ব্যবস্থা আছে। সে বিচার কোথায়?

গত সপ্তাহে ভারতের পরাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ঢাকায় এসেছিলেন। আমরা তো ভেবেছিলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর উপলক্ষে আলাপ-আলোচনা করতে তিনি ঢাকা এসেছেন। কিন্তু দেখা গেল, তা নয়। তিনি এসেছেন সীমান্ত হত্যাকে একটি যৌক্তি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য। ঢাকা এসে তিনি বললেন, ‘নো ক্রাইম, নৌ ডেথ’। অপরাধ না হলে মৃত্যু হবে না। মৃত্যু তো নয়, হত্যা। ভারতের চারপাশে যেসব দেশ রয়েছে, তাদের সবার কাছে ভারতের শত্রুতামূলক সম্পর্ক। কিন্তু কোনো সীমান্তেই ভারত এভাবে পাখির মতো গুলি করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে পারে না। পাকিস্তান সীমান্তে পারে না। নেপাল সীমান্তে পারে না। মিয়ানমার সীমান্তে পারে না। চীন সীমান্তে তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে বাংলাদেশ সীমান্তে পারে কেন? সে আমাদের নতজানু মেরুদ-হীন পররাষ্ট্র নীতির কারণে। ভারত বলে, বাংলাদেশে গরু পাচার হয়। কিন্তু সে গরু সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায় বিএসএফ। সে গরু আনতে যায় যে বাংলাদেশিরা তারা অপরাধী। তাদের তৎক্ষণাৎ গুলি করে হত্যা করা যায়। কিন্তু যে বিএসএফ সদস্যরা সেগুলো এগিয়ে দিল, তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় না কেন?

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিষ্টি মিষ্টি হেসে হয় হয় করেন। ভারত যে যুক্তি দিয়েছে, সেটা ঠিক ঠিক ঠিক। কি বিগলিত হাসি। আজ পর্যন্ত আ’লীগ সরকারের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখলাম না, যিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন যে, না, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। এভাবে বিনা বিচারে হত্যাকা- চলবে না। কিন্তু জয় শঙ্করের বার্তা স্পষ্ট। সীমান্তে অপরাধ প্রধানত বন্ধ না হলে হত্যাকা- চলবে এবং বাংলাদেশকে তা মেনে নিতে হবে। ঢাকায় যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে জয়শঙ্কর সেটা স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু আমাদের নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো অপরাধ। তাই আমাদের লক্ষ্য নো ক্রাইম নো ডেথ বডার। আমি নিশ্চিত যে, আমরা যদি সে ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে এই সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, বেশ কিছু বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে ভারতের বেশ ভেতরে।

আমরা খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করতে পারি, ভারতে কি প্রত্যেক অপরাধীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। তাহলে বাংলাদেশি হলে বিএসএফ কেন গুলি ছুঁড়বে? আর ভারতের বেশ ভেতরে বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করাই কি একমাত্র ব্যবস্থা? কিন্তু প্রতিবাদ করলেন না আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মিষ্টি মিষ্টি হেসে তিনি যেন জয় শঙ্করের বক্তব্য উপভোগ করলেন। টুঁ শব্দটিও করলেন না। এমনকি কোনো স্বগোতোক্তিও নয়। প্রথমত ভারত তার সীমান্তকে অপরাধমূলক করে ফেলেছে। দ্বিতীয়ত ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারত ৪৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এরা সবাই অপরাধী? এই সংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এক দশক ধরে ভারতের সঙ্গে যে অপার বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে, এটা কি তারই ফসল? যাদের খুন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচজনকে বিএসএফ ভয়াবহ নির্যাতন করেছে। জয় শঙ্কর এখানে কোনো রাখঢাক করেননি। তিনি সীমান্ত হত্যার সমস্ত দায় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সোজা বলে দিয়েছেন, সীমান্তে বাংলাদেশিরা অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ করলেই কেবল সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে। তার আগে নয়।

আমরা তো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করকে জিজ্ঞেস করতেই পারি যে, অপরাধমূলক তৎপরতা কাকে বলে? যদি চোরাচালান অপরাধমূলক তৎপরতা হয়, তাহলে আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি, এই চোরাচালানের জন্য কি শুধু বাংলাদেশিরা দায়ী? তাহলে ভারতীয় গরু কীভাবে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে আসে এবং কারা সেগুলোকে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ঠেলে দেয়। যারা নিয়ে আসে ও ঠেলে দেয়, তারা কি তবে অপরাধী নয়? তবে কি তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করা উচিত নয়? কিন্তু এক্ষেত্রে বিএসএফই বিচারক, আইনজীবী ও মৃত্যুদ- কার্যকরকারী। ভারত সরকার তাদের সে অধিকার দিয়ে দিয়েছে।

এখন ভারতীয় নীতি হচ্ছে- বিএসএফ সঙ্গে সঙ্গে যে সাজা দিতে পারবে, তা হলো মৃত্যুদণ্ড। এখানে দণ্ডিতের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্র এ রকম একটা আইন করল মেক্সিকো সীমান্তে- কেউ সীমান্ত পাড়ি দেবার চেষ্টা করলে মার্কিন বর্ডার গার্ড তাদের গুলি করে মারবে। তাহলে তো সেখানে প্রতিদিন কয়েকশ’ লোক খুন হবে। সেটা কি কল্পনা করা যায়?

তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও আছে এমন টালবাহানা। নরেন্দ্র মোদিও বলেন, পানি বণ্টনে তারা আন্তরিক। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির কারণে দিতে পারছেন না। এটা খোঁড়া যুক্তি। সম্প্রতি শিলিগুড়ির এক জনসমাবেশে মমতা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের পানির চাহিদা না মিটিয়ে কাউকে তিস্তার এক ফোঁটা পানিও তিনি দেবেন না। তাহলে মোদির কথার কী মূল্য থাকল ? সুতরাং শক্ত হাতে ব্যবস্থা না নিলে সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হবে না, তিস্তার পানিও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশকে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে হবে।

https://dailysangram.com/post/446343