১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৫:৩৫

বসুরহাটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ

ফেনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি কোম্পানীগঞ্জে

রাজনৈতিক ‘মদদপুষ্ট’ অস্ত্রধারীর অধিকাংশই অধরা * অস্ত্র সরবরাহকারীদের অনেকেই জনপ্রতিনিধি * সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে পুলিশ

নোয়াখালীর বসুরহাটে মঙ্গলবার আবদুল কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদল গ্রুপের গোলাগুলিতে অংশ নেয় দুই পক্ষের অন্তত দুই ডজন অস্ত্রবাজ। এদের বেশির ভাগ ভাড়াটে। সেখানে অস্ত্রের চালান আসে মূলত ফেনীর সোনাগাজী থেকে। তবে সেগুলো নোয়াখালী সদর, কবিরহাট ও সেনবাগ হয়ে বসুরহাটে পৌঁছে। বিদেশি অস্ত্রের পাশাপাশি শটগান ও দেশি কাঁটাবন্দুক ব্যবহার করে ‘প্রশিক্ষিত শুটার বাহিনী’র সদস্যরা।

ওইদিনের ঘটনায় দুপক্ষই পরিকল্পিতভাবে অস্ত্রবাজ জড়ো করলেও প্রাথমিকভাবে ফায়ারিংয়ের সিদ্ধান্ত ছিল না। কিন্তু কাদের মির্জা গ্রুপের এক অস্ত্রবাজ পৌর ভবনের পাশের ছাদ থেকে প্রথম গুলি চালালে পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যায়। দুপক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। গুলিবিদ্ধ হয়ে বাদল গ্রুপের একজন নিহত হন। দুপক্ষেরেই আহত হন অনেকেই।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও অপারেশন চালিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় অস্ত্রবাজরা। তবে উপরের নির্দেশে এখন তাদের শনাক্ত, গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে ‘সাঁড়াশি’ অভিযানে নেমেছে পুলিশ। অস্ত্রকারবারি, আন্ডারওয়ার্ল্ড ও পুলিশ সূত্রে মিলেছে উল্লিখিত সব তথ্য।

স্থানীয়দের ভাষ্য, এসব অস্ত্রবাজরা ‘রাজনৈতিক মদদপুষ্ট।’ এদের সম্পর্কে পুলিশের কাছে তথ্যও আছে। কিন্তু যেহেতেু এদের যারা ব্যবহার করছেন, তারা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার ঘনিষ্ঠ, তাই পুলিশও আগ বাড়িয়ে তাদের গ্রেফতার করতে আগ্রহী নয়। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে স্থানীয় পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো মানুষকে রশি দিয়ে শক্ত করে হাত-পা বেঁধে পুকুরে সাঁতার কাটতে দিলে যেমন তিনি সাঁতার কাটতে পারেন না, আমাদের অবস্থাও ঠিক সেরকমই। এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে চাই না।’

জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা অস্ত্রবাজি করেছে, তারা অপরাধী। তাদের রাজনৈতিক মদদের কোনো বিষয় নেই। তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কাজ করছি। অভিযান চলমান আছে। এজন্য এলাকায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। অস্ত্রবাজরা আত্মগোপন করে থাকতে পারবে না। শিগগিরই তারা ধরা পড়বে।’

সাধারণ প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ, পেশাদার অস্ত্রবাজ ও কারবারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার বসুরহাটে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপই পেশাদার অস্ত্র ও বোমাবাজ জড়ো করেছিল। মেয়র কাদের মির্জার গ্রুপে যোগ দেওয়া অস্ত্রবাজদের কোম্পানীগঞ্জের বাইরে থেকে এনে তোলা হয়েছিল পৌর ভবন ও পাশের আরেকটি ভবনের ছাদে।

তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্থানীয় অস্ত্রবাজরাও। এ গ্রুপের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন দুই হাতে অস্ত্র চালনায় পটু দুর্ধর্ষ অস্ত্রবাজ নাজিম উদ্দিন মিকন। তার সঙ্গে ছিলেন কসাই কাঞ্চন, সিরাজপুর কড়ালিয়ার রাসেল ওরফে কেচ্ছা রাসেল, মিরেরপুলের সুমন, বড় রাজাপুরের ওয়াসিম, জমিস ও টুটুল মজুমদার। তাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। কসাই কাঞ্চন ও জসিম এর আগেও অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল। বাকিদের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা আছে। এ ছাড়াও চরপার্বতী ইউনিয়নের একজন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমেও আসে অস্ত্র।

তবে বুধবার যুগান্তরকে আব্দুল কাদের মির্জা সাফ জানিয়েছেন, ‘আমি অস্ত্রের রাজনীতি করি না। আমার কোনো অস্ত্রবাজ বাহিনী নেই। দরকারও হয় না। বাদল পরিকল্পিতভাবে সুবর্ণচর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা থেকে অস্ত্রবাজদের এনে হামলা চালায়। বাদলের গ্রুপের এখানকারও ৫০-৬০ জনের অস্ত্র আছে। বাকিরা বাইরে থেকে আসে।

অন্যদিকে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের গ্রুপের অস্ত্রবাজ ক্যাডারদের পাঠানো হয়েছিল ফেনীর সোনাগাজী থেকে। ফেনীর প্রভাবশালী এক সংসদ সদস্য, একজন মেয়র ও একজন উপজেলা চেয়ারম্যান বাদলের ঘনিষ্ঠ। যাদের দিকে কথায় কথায় অপরাজনীতি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ তোলেন মির্জা কাদের।

ওই জনপ্রতিনিধিদের পরিকল্পনায় সোনাগাজী উপজেলার চরাঞ্চলের পাশাপাশি অবস্থিত দুটি ইউনিয়নের দুই বাসিন্দা বাদলকে জোগান দেন অস্ত্রের চালান। তারাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। এছাড়া চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের একজন জনপ্রতিনিধি বাদল গ্রুপের ক্যাডারদের অস্ত্রের জোগান দিয়ে থাকেন।

অস্ত্রের জোগান পাওয়ার পর বেশ কিছুসংখ্যক অস্ত্রবাজ তিন গ্রুপে ভাগ হয়ে সোনাগাজী থেকে কোম্পানীগঞ্জে ঢোকে। এরপর সশস্ত্র অবস্থায় তারা বসুরহাট পৌর চত্বরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াতকে মারধর করার ঘটনার প্রতিবাদে ডাকা কর্মসূচিতে অংশ নেন।
বাদল গ্রুপের অস্ত্রধারীদের নেতৃত্ব দেন চাপরাশির হাটের ফাল্গুন।

তবে বাদলের অস্ত্রবাজরা বেশির ভাগই কোম্পানীগঞ্জের বাইরের হওয়ায় পুলিশ তাদের শনাক্ত করতে পারেনি। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, বাদল গ্রুপের দুর্ধর্ষ আরেক অস্ত্রবাজ বেলাল ওরফে পাংখা বেলাল। সাংবাদিক মুজাক্কির হত্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বাদল অস্ত্রবাজি ও হামলার পুরো দায় চাপান আব্দুল কাদের মির্জার ওপর। তিনি বলেন, মির্জা কাদেরের অনুসারী অস্ত্রধারীরা ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়েছে। এটা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও সাংবাদিকরা দেখেছেন। আমার লোকজন হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে যেতেও পারেনি। পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে। আর আমি জনগণের রাজনীতি করি। জনগণ আমার সঙ্গে থাকে। এজন্য অস্ত্রবাজ বাহিনী দরকার হয় না।’

সাঁড়াশি অভিযান : অস্ত্রবাজদের ধরতে বুধবার গভীর রাত থেকে স্থানীয় থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ যৌথভাবে কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে।

রাত ৩টা থেকে ভোর পর্যন্ত অন্তত ১০টি জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলেও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তবে পুলিশ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার্স ইনচার্জ মীর জাহেদুল হক রনি যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু অস্ত্রবাজরা বেশির ভাগই কোম্পানীগঞ্জের বাইরের, অস্ত্রও আসে বাইরে থেকে। তাই ঘটনার পরই অস্ত্রবাজরা আত্মগোপনে চলে গেছে।

এখন তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে গ্রেফতার করাটা একটু কঠিন। তবে অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। তারা ধরা পড়বেই।’

অস্ত্রবাজদের ছবি পৌর ভবনের সিসি ক্যামেরায় : প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপক্ষের মধ্যে গোলাগুলির সময় স্থানীয় সাংবাদিক ও উৎসুক জনতার ওপর অস্ত্রধারী ও তাদের সহযোগীদের কড়া নজরদারি ছিল।

গোলাগুলির দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও স্থানীয় মানুষ লাঞ্ছিত হয়েছেন।

এমনকি গোলাগুলির ঘটনায় মির্জা কাদেরের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা আরিফুর রহমান বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় ব্যক্তিগত অফিসে হামলা ও ভাংচুরের অভিযোগে মামলাও দায়ের করেছেন।

ওই মামলায় বাদলের অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিক ইকবাল হোসেন মজনু ও প্রশান্ত সুভাস চন্দকেও আসামি করা হয়েছে। দুই সাংবাদিকের অভিযোগ, ঘটনার দিন হামলার ছবি ধারণ করতে গিয়েছিলেন বলেই তাদের আসামি করা হয়েছে।

এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে বসুরহাট পৌর ভবনে বসানো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা চালু ছিল। ওই সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে গোলাগুলির দৃশ্য। কিন্তু ক্যামেরাগুলো মেয়র কাদের মির্জার নিয়ন্ত্রণে থাকায় ফুটেজগুলো সরিয়ে ফেলা হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

স্থানীয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, ওই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের ধারণা-এরই মধ্যে ফুটেজগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

তাই বিকল্প উপায়ে অস্ত্রবাজদের শনাক্ত করছেন তারা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন অস্ত্রবাজের পরিচয়ও নিশ্চিত হতে পেরেছে পুলিশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/401002