১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৫:৩১

করোনা মহামারিতে নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়েছে

মুহাম্মদ নূরে আলম: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের সূচকে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসির সুপারিশের ভিত্তিতে এটি হয়েছে। একে দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এই উন্নয়নে নারীদের অবদান থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখনও পিছিয়ে রয়েছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ জন্য সমাজ ব্যবস্থা, আইনি সুবিধা না পাওয়া ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন। এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলকালীন সময়ে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া নানা সংকট মোকাবিলা করে বাকি ২০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট (স্টেপস) এবং জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্স (গ্যাড অ্যালায়েন্স)-এর যৌথ উদ্যোগে দেশের ১০ জেলায় সম্প্রতি চারশো জন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার মোবাইল ফোনে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তৈরি প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।

বিশ্বব্যাংক, মাস্টারকার্ড, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই), বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) বিভিন্ন প্রতিবেদনেব্যবসায় নারীদের সাফল্য ও প্রতিবন্ধকতা তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বে নারী উদ্যোক্তাবান্ধব অর্থনীতির দেশের মধ্যে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া ও স্পেন পর্যায়ক্রমে শীর্ষ অবস্থান করছে। উদ্যোক্তাবান্ধব ও গতিশীল পরিবেশ, শক্তিশালী ব্যবসায়িক যোগাযোগ, কার্যকর সহায়তা ব্যবস্থা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনের জন্য তারা শীর্ষে অবস্থান করছে। (মাস্টারকার্ড গবেষণা প্রতিবেদন ২০২০)।

বাংলাদেশে ব্যবসায়ী সংগঠনে মাত্র ১৫ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রয়েছে। আর যেসব নারীরা বড় উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বা আছেন, তাদের বেশিরভাগ পারিবারিক ব্যবসার মাধ্যমে এসেছেন। সাধারণত বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা কৃষি ও মৎস্য চাষের মতো এসএমই খাতে কাজ করছেন। এখাতে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ২১ শতাংশ। আর কর্মক্ষেত্রে নারীরা শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত রয়েছেন। যার সিংহভাগ তৈরীপোশাক শিল্পে।

গবেষণা দেখা গেছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারির এ সময়ে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের ৮৭ শতাংশ দাবি করছেন করোনার কারণে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস’ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের কর্মক্ষম নারীর মধ্যে ৩৬ শতাংশ কর্মে রয়েছেন। আর পুরুষদের অংশগ্রহণ ৮১ শতাংশ। কর্মে নারীদের অংশগ্রহণ কমথাকা এবং নেতৃত্বে পিছিয়ে থাকার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা নারীবান্ধব না হওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ। ভারতে নারীদের মধ্যে কর্মক্ষম ২০ শতাংশ কর্মে যুক্ত আছেন, আর পুরষের হার ৭৬ শতাংশ।

এদিকে, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে আইনি সুরক্ষায় পুরুষের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা অর্ধেক সুবিধা পেয়ে থাকে বলে দাবি বিশ্বব্যাংকের। ১৯০টি দেশে ব্যবসায় বা কর্মক্ষেত্রে নারীর আইনি সুরক্ষায় বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ওমেন বিজনেস অ্যান্ড দ্যা ল ২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর্মক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের থেকে খারাপ অবস্থানে আছে আফগানিস্তান। বিশ্বে বাংলাদেশের থেকে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাত্র ১৮টি দেশ।

দেশের ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল ও চট্টগ্রাম জেলায় এ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা এক জরিপে স্টেপস জানায়, মোবাইল ফোনে সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, করোনা মোকাবিলার জন্য ঘোষিত সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের পর থেকে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের চলমান ব্যবসা বা উদ্যোগ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন। নানা সংকট মোকাবিলা করে বাকি ২০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী তাদের উদ্যোগ বা ব্যবসা পরিচালনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, লকডাউনকালীন সময়ে পরিবারের খাবার ও অন্যান্য চাহিদা পূরণ করার জন্য তারা তাদের ব্যবসার মূলধন খরচ করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলেও মূলধনের অভাবে তাদের ব্যবসা বা উদ্যোগগুলো পরিচালনা করা কঠিন হবে।

স্টেপস জানায়, জুন থেকে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হলেও গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের নানান প্রতিবন্ধকতা ও নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যার ফলে তাদের এতদিনের শ্রমে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ নারী উদ্যোগের এই ধারাবাহিকতা বিঘিœত হলে নারীর সামগ্রিক অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে, এসময়ে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের আয় না থাকার কারণে নারী উদ্যোক্তাদের ওপর পুরো সংসারের দায় এসে পড়েছে। অন্যদিকে করোনাকালে স্থানীয় পর্যায়ের মার্কেট বন্ধ থাকাসহ মানুষের সীমিত চলাচলের কারণে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায় তাদের সংকটে পড়তে হয়েছে। এর ফলে একদিকে কমেছে তাদের নিজেদের আয়, অন্যদিকে তাদের উৎপাদন সহযোগী গ্রামীণ অসহায় নারীদের মজুরি প্রদানেও ব্যর্থ হয়েছেন।

স্টেপসের প্রতিবেদনে পরামর্শ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রণোদনার অংশ হিসেবে দেশে গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ঋণ প্রদান করতে হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য যাতে পুনরায় বাজারে সহজে প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং প্রণোদনার অংশ হিসেবে গ্রামীণ ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের এককালীন সহায়তা প্রদান করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/446345