১২ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ৫:২৯

সরকারি সহায়তার অর্থ পায়নি মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত তালিকার ১৮ লাখ পরিবার

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: গত বছর ঈদ-উল ফিতরের আগেই ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ২৫০০ টাকা করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। গত বছরের ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার সময় মহামারিতে কর্মহীন দরিদ্রদের জন্য এ সহায়তা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু উপকারভোগীদের তালিকা করতে ব্যর্থতার কারণে ঈদ উল আযহার আগে ১৪ মে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। নগদ সহায়তা দেওয়া বাবদ ১২৫৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। তবে ছাড়ের প্রায় অর্ধেক টাকাই বিতরণ হয়নি। আবার সরকারি সহায়তার অর্থ পায়নি মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত তালিকার ১৮ লাখ পরিবার।

জানা যায়, উদ্যোগটির সঙ্গে জড়িত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ। আর পরিবার চিহ্নিত করা হয়েছিল স্থানীয় সরকার অর্থাৎ জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পর পরিবারপ্রতি এক হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। পরে ভাবা হয় দুই হাজার টাকা করে দেওয়ার। কিন্তু শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই তালিকায় রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, দোকানের কর্মচারী, ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায় কর্মরত শ্রমিক, পোলট্রি খামারের শ্রমিক, বাস-ট্রাকের পরিবহনশ্রমিক, হকারসহ নানা পেশার মানুষকে তালিকার মধ্যে রাখা হয় বলে জানিয়েছিলেন দুর্যোগসচিব মো. শাহ্ কামাল।

তবে দরিদ্র পরিবারের তালিকা করার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি করে সরকারি চাকরিজীবী ও ধনী পরিবারগুলোকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ভুল সংশোধন, অযোগ্যদের বাদ দিয়ে নতুন করে দরিদ্রদের অন্তর্ভুক্ত করাসহ নানা দুর্বলতায় শেষ পর্যন্ত ৩২ লাখ দরিদ্র পরিবার প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার পেয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে নগদ সহায়ত দেওয়া বাবদ ১২৫৭ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। তার মধ্যে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৩২ লাখ পরিবারকে ৮১১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরে সব ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু হওয়ার পর বাকি টাকা ফেরত নেয় অর্থমন্ত্রণালয়। বিতরণ করা অর্থ থেকে এখন ১০১ কোটি টাকা ফেরত এলে এখাতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭১০ কোটি টাকা।

গত ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ৩২ লাখ এমএফএস একাউন্টে ৮১১ কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে ৪ লাখ ২ হাজার ১৬৮টি এমএফএস একাউন্টের পিন ইনএকটিভ অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ, গ্রাহক এসব হিসাব আর চালু করেনি। এসব হিসাবে বিতরণ করা অর্থের পরিমাণ ১০১ কোটি টাকারও বেশি। তাদের মোবাইল অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর ইনঅ্যাকটিভ থাকায় সহায়তার টাকা তুলতে পারেননি তারা। এসব টাকা চারটি মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আছে, সরকারি কোষাগারে ফেরত যাবে এই অর্থ।

মোট ৫০ লাখ পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর কাজের মধ্যে বিকাশের ভাগে ছিল ১৫ লাখের দায়িত্ব। সবচেয়ে বেশি ১৭ লাখ পরিবারের কাছে টাকা পাঠানোর দায়িত্ব পায় নগদ। বাকি ১৮ লাখ পরিবারের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল রকেট ও শিওরক্যাশের।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, মুজিববর্ষে মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান কর্মসূচির আওতায় তালিকাভুক্তদের মধ্যে যাদের এমএফএস একাউন্ট ছিল না, তাদের দেওয়া মোবাইল নম্বরের বিপরীতে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে এমএফএস হিসাব খুলে সেই হিসাবে নগদ সহায়তার টাকা পাঠানো হয়েছে।

অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকদের একাউন্ট খুলে দেওয়ার পর পিন সচল করার জন্য প্রচারণা চালানো দরকার ছিল। কিন্তু এমএফএস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে তা করেনি। ফলে অনেকে জানেনই না যে, তাদের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এবং সরকার থেকে তাদের অ্যাকাউন্টে সহায়তার টাকা পাঠানো হয়েছে। কোম্পানিগুলো খরচ বাঁচানোর জন্য এ ধরণের প্রচারণা চালায়নি, সরকার থেকেও কোনরকম প্রচারণা চালানো হয়নি। ফলে উপকারভোগীরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

চারটি মোবাইল আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এই ১০১ কোটি টাকা ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে, তা জানতে চেয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি অর্থবিভাগকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. মেজবাউল হক স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, পিন ইনঅ্যাকটিভ থাকা হিসাবগুলোকে পূর্ণাঙ্গ এমএফএস অ্যাকাউন্ট হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না, ফলে সরকারের বিতরণ করা অর্থ দীর্ঘদিন যাবৎ অনুত্তোলিত রয়েছে, যা এমএফএস প্রোভাইডারদের হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে।

নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির এ মিশুক জানান, সার্ভিস প্রোভাইডাররা একাউন্ট খুলে দেওয়ার পর গ্রাহক পিন সেট আপ করেননি। ফলে পিনগুলো ইনঅ্যাকটিভ রয়ে গেছে। গ্রাহকদের সচেতন করতে নগদ এমএসএম দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। বাড়তি ব্যয়ের কারণে অন্য প্রোভাইডারগুলো এ ধরণের প্রচারণায় যায়নি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জানান, এ ধরণের কর্মসূচি থেকে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা সব সময়ই অর্থ আত্মসাত করে। এবারও তারা বিভিন্ন মানুষের নামে নিজেদের একটি নম্বর দিয়ে কিংবা আত্মীয় স্বজনদের তালিকাভুক্ত করে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করেছিল। সরকারের সতর্কতার কারণে তারা সফল হতে পারেনি। তবে তাদের ব্যর্থতার কারণে প্রায় অর্ধেক দরিদ্র পরিবার সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

দরিদ্রর সংখ্যার ব্যাপারে সরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর সিনিয়র গবেষক ড: নাজনীন আহমেদ জানান, আমাদের তিন কোটি ৮০ লাখ মানুষ দরিদ্র। তাদেরই সবাইকে আমরা বিভিন্ন সময় সামাজিক সুরক্ষার আওতায় সহায়তা দিতে পারি না। এখন করোনা পরিস্থিতিতে এই আকারটা অনেক বড়। শুধু ঐ দরিদ্র গোষ্ঠী নয়, তার সাথে নি¤œ মধ্যবিত্ত, হঠাৎ দরিদ্র হয়ে যাওয়া অনেক মানুষ কিন্তু যুক্ত হয়েছে। ফলে সরকার যত মানুষকে সাহায্য দিতে চাইছে, সেখানে সাহায্য পাওয়া উচিত-এমন মানুষের সংখ্যা কিন্তু অনেক বেশি।

সার্বিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আরও বাড়বে। তারপরও আমি বলব, এটা অবশ্যই সরকারের প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ ছিল।

https://dailysangram.com/post/446307