১৩ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১:২০

প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্দশা

বাস্তবায়ন হার ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩৩.৮৩ শতাংশ; স্বাস্থ্য ও টেলিযোগাযোগ খাতে ৮ মাসে সবচেয়ে কম অগ্রগতি; অদক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে দায়ী করলেন অর্থনীতিবিদরা

চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) বেশির ভাগ সময় বা ৮ মাস ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে। পুরো চার মাস সময়ও আর বাকি নেই। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র দীর্ণদশা। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতি বাড়ানোর জন্য নিজে মাঠপর্যায়ে সরেজমিন পরিদর্শনও করেন। প্রকল্প পরিচালকদের নিয়েও বৈঠক করে নির্দেশনা দেন। কিন্তু এতে কোনো অগ্রগতি নেই। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৮ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গত পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন রেকর্ড করেছে। এই হার ৩৩.৮৩ শতাংশ। আগের বছরের চেয়ে ব্যয় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। আর ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা আরো খারাপ বলে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এডিপি বাস্তবায়নে এই থমকে যাওয়া ও দীর্ণদশার জন্য মন্ত্রণালয়গুলো দায়ী। তাদের গাফিলতির কারণেই উন্নয়ন প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাস্তবায়ন হোক বা না হোক বছর শেষে ৯০ শতাংশ টেনে দেখানো হয়।
আইএমইডির তথ্য থেকে জানা গেছে, করোনার প্রথম ঢেউয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার ভালো ছিল। গত জানুয়ারি থেকে জুন’২০ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ছিল ৫৪ শতাংশ। কিন্তু জুলাই টু ডিসেম্বর’২০২০ অর্থাৎ করোনা পরবর্তীতে সেই হার ২৩.৮৯ শতাংশে নেমে আসে। ঝিমিয়ে পড়েছে। জুলাই টু ফেব্রুয়ারি’২০২১ পর্যন্ত অর্থাৎ ৮ মাসে বাস্তবায়নের হার ৩৩.৮৩ শতাংশ। যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের বছরগুলোতে ২০১৯-২০ অর্থবছর ৩৭.২৬ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৩৯.১৩ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৩৮.০১ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৩৬.৯১ শতাংশ বাস্তবায়ন হার ছিল প্রথম ৮ মাসে। এমনকি চলতি অর্থবছর খরচও প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে।

জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর এডিপির বরাদ্দ ছিল মোট ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবি ৬২ দশমিক ৭৪ শতাংশ বা এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। আর প্রকল্প সাহায্য ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত ৮ মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি’২০২১ পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর বিপরীতে খরচ হয়েছে ৭২ হাজার ৬০৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগের বছর একই সময়ে খরচ হয়েছিল ৮০ হাজার ১৪৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। এই খরচকেই বাস্তবায়নের হার হিসাবে প্রকাশ করা হয় সরকারিভাবে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে বাস্তবায়ন হার ৫.৩৮ শতাংশ বা ১১ হাজার ৫৫৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অন্যদিকে, সরকারি খাতের অর্থও খরচের হার গত পাঁচ বছর একই সময়ের তুলনায় চলতি বছর কম। প্রথম ৮ মাসে এই বাস্তবায়নের হার ৩৪.২৭ শতাংশ এবং প্রকল্প সাহায্য ৩৪.৭১ শতাংশ। ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করতে পেরেছে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ১০ শতাংশে নিচে খরচ করতে সক্ষম ছিল ৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। গত ৮ মাসে নিজস্ব অর্থও ব্যবহার করতে পারেনি ধর্ম মন্ত্রণালয়।

দেখা যায়, বৃহৎ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫ মন্ত্রণালয়ের একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৮.০৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৪২.০৫ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ৪১.৯৫ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৩৪.৩৩ শতাংশ, রেলপথ মন্ত্রণালয় ৩৪.৫৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হার। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ মাত্র ২১.৩৮ শতাংশ ও সেতু বিভাগ ২৫.১৬ শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নেই। অদক্ষতাও একটা অন্যতম কারণ। মন্ত্রণালয়গুলো কোনো ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি নেয় না। বসে থাকে কখন টাকা ছাড় হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই এটা একেবারে ঠিকও নয়। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন দলের এবং নিজ দলের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। নোয়াখালী তার একটা উদাহরণ। তারপরও মূল কারণ বাস্তবায়নে গাফিলতির জন্য কোনো ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

প্রকৃত বাস্তবায়ন বছর শেষে কত হতে পারে জানতে চাইলে ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ হতে পারে। আমাদের এখানে ৭-৮ মাসে ৩০-৩৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়। বছর শেষে সেটাকে টেন ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত টেনে উঠানো হয়। এখানে কাজ হোক বা না হোক।
এডিপি বাস্তবায়ন হার পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এডিপি বাস্তবায়নের বড় দুর্বলতা হচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলোর গাফিলতি। এখানে জবাবদিহিতার যথেষ্ট অভাব আছে। নিবিড় তদারকি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে উন্নয়ন কাজের কাক্সিক্ষত গতি আসবে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/568814