১৩ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১:১৭

এলডিসি থেকে বের হওয়ায় বাংলাদেশের লাভক্ষতি

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হচ্ছে বাংলাদেশ এতে কত লাভ কত ক্ষতি। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটলে তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংসদীয় কমিটি। এর ফলে পাঁচ বছর প্রস্তুতিকালীন সময় কাটানোর পর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের লাভ বা ক্ষতি কতটুকু হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত হিসাব নেই সরকারের কাছে।

সিডিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে শুধু এলডিসির তালিকা থেকে বের হওয়ার দিকেই মনোযোগী হলে চলবে না। এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর আবার যাতে এলডিসিতে ফেরত আসার ঝুঁকি না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। কেননা, এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) ‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি বার্ষিক ১১ শতাংশ হারে কমতে পারে। এতে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হতে পারে। তবে এটি অনুমাননির্ভর হিসাব।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতার পর তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে চিহ্নিত একটি রাষ্ট্র ৫০ বছরের মধ্যে সেই অপবাদ ঘুচিয়ে উন্নয়নশীলে উত্তরণ ঘটছে-বহির্বিশ্বে এটিই সবচেয়ে বড় অর্জন। এর ফলে বাংলাদেশের মর্যদা বৃদ্ধি পাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়বে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। বিনিয়োগ বাড়ার কারণে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়বে। আয় বাড়ার কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। এর ফলে বিভিন্ন খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়বে। আবার এলডিসি থাকার কারণে বহির্বিশ্বে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে জামানত ও সুদের হার বেশি পড়ে। উন্নয়নশীলে উত্তরণের কারণে রিস্ক ফ্যাক্টর কমে যাবে। এতে করে বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হার কমবে। বেসরকারি খাতে অর্থায়ন সুবিধা বাড়বে। এটিও বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। আবার সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব সম্পদ সূচকে আরও উন্নয়ন ঘটবে। নতুন বিনিয়োগের লক্ষ্যে সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন হবে। এ ছাড়া প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমদানি-রপ্তানি নীতিসহ সরকারের কর নীতিতে পরিবর্তন আসবে। এতে করে বহির্বাণিজ্যে সক্ষমতা বাড়বে বাংলাদেশের। আবার কারখানা ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পণ্য রপ্তানিতে দরকষাকষির সুযোগ বাড়বে বাংলাদেশের।

২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ভারত ও চীন ছাড়াও উন্নত দেশগুলোতে যে বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে, সেটি আর পাওয়া যাবে না, ২০২৯ সালের পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)-এ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে; এলডিসি হিসেবে মেধাস্বত্ব, পেটেন্ট, তথ্য প্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীলে উত্তরণের পর বিনামূল্যে এসব প্রযুক্তি বা সেবা মিলবে না, ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ পেটেন্ট লাইসেন্স ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। ২০৩৩ সালের পর এই সুবিধা আর পাওয়া যাবে না, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের অনুদান ও সহজশর্তে ঋণ সহায়তা পাচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু তহবিল থেকে বিশেষ বরাদ্দ রয়েছে। ২০২৬ সালের পর এসব অনুদান বা সহায়তা মিলবে না, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিশেষ সহায়তা পাওয়া যায়। এসব সহায়তা আর ২০২৬ সালের পর পাওয়া যাবে না, এনজিওগুলোও বর্তমানে যেসব খাতে অনুদান পাচ্ছে তা আর পাবে না, এমন কি বর্তমানে যে রেয়াতি সুদে অর্থাৎ সহজ শর্তে বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকে ঋণ মিলছে সেটিও আর মিলবে না। তাদের ঋণের সুদের হার বেড়ে যাবে, এ ছাড়া এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। রপ্তানি খাতে দিচ্ছে নানা ধরনের প্রণোদনা সুবিধা। এমন কী রেমিট্যান্স আয়েও নগদ সহায়তা দিচ্ছে। এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে এসব ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আসবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা নির্ভর অর্থনীতির দিকে যেতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে অবকাঠামোসহ ব্যবসায় পরিবেশ সক্ষমতা, বন্দর সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলেও পণ্যের দাম ঠিক রেখে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখা যায়।

গত বুধবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটলে তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ বিষয়ে আগেভাগে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান বৈঠকের পর বলেন, আমরা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে খুশি হচ্ছি। কিন্তু উত্তরণের ফলে যে প্রভাবগুলো পড়বে তা বিবেচনা করতে হবে। প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বেকারত্ব বেড়ে যাবে।

বিশেষ করে আমাদের ওষুধ শিল্প ও গার্মেন্ট শিল্পের বিষয়টি দেখতে হবে। ওষুধ শিল্পের পেটেন্ট বাবদ টাকা প্রদান করতে গেলে ওষুধ সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাবে। দেখা যাবে প্যারাসিটামলের একপাতা (১০টি ট্যাবলেট) দুইশ টাকা হয়ে গেছে। এটা যাতে না বাড়ে তার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে যেসব সুবিধা বাংলাদেশ পাচ্ছে, সেগুলো আরও ১০ বছর পাওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে সরকারকে তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেন ফারুক খান। আমরা একটি চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে অস্ত্র বাদে সব ধরনের পণ্য বিনা শুল্কে রপ্তানি করতে পারি। এগুলো যাতে অব্যাহত থাকে, তার জন্য এখনই থেকেই আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

উত্তরণের এই পর্যায়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফারুক খান বলেন, অতীতে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়া অনেক দেশ কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে। তারা এলডিসি থেকে বেরিয়ে আবার এলডিসি হয়ে গেছে। এসব বিবেচনা করতে আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, দুর্নীতি যেটা আছে তা বন্ধ করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশে গেলে সব সেক্টরে ট্যাক্স বাড়াতে হবে। কিন্তু আয় না বাড়লে ট্যাক্স বাড়ালে তো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। এগুলোর বিষয়ে ভাবতে হবে।

https://dailysangram.com/post/446432