১৩ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১:১৬

বন্ধ হচ্ছে না জামিন জালিয়াতি বিপাকে উচ্চ আদালত

একের পর ঘটে যাচ্ছে জামিন জালিয়াতির ঘটনা। তাও আবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সার্টিফাইট কপি জাল করে, ভুয়া জামিননামা তৈরী করে অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতের সাথে প্রতারণা করে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে আসামীরা। আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে টাকা হাতাতে উচ্চ আদালতে তথ্য জালিয়াতি করছে তারা। সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা নজরে আসে হাইকোর্টের। জালিয়াতির ঘটনা আদালতের নজরে আসলে আসামীদের জামিন বাতিল করে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এতে কোন কোন আসামী গ্রেফতার হচ্ছে আবার কোন কোন আসামী পলাতক হয়ে যাচ্ছে। এমনই এক ঘটনায় বগুড়ার ত্রিশজন আসামীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের ভুয়া জামিননামা তৈরি করে জামিন জালিয়াতির ঘটনায় বগুড়া সদর উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি) ও কাউন্সিলর মো. আমিনুর ইসলাম, আব্দুল আলিম, আনোয়ার মণ্ডলসহ ৩০ জনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাদেরকে গ্রেফতারের জন্য বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই আদেশ বাস্তবায়ন করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি)। এছাড়া সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করতে বগুড়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম সাংবাদিকদের বলেন, একজন আইনজীবী সকালে কোর্টে এসে খবর নেন এ মামলায় ৩০ জন আসামির জামিন হয়েছে কি-না। তখন কোর্টের বেঞ্চ অফিসার বললেন, আমাদের কোর্ট থেকে এ ধরনের কোনো আগাম জামিন হয়নি। এমন কোন অর্ডার আমরা পাস করিনি।

এ সময় বেঞ্চ অফিসার তার কাছে জানতে চান জামিন আদেশের কপি দেখতে চাইলে ওই আইনজীবী বলেন, মোবাইলে ছবি আছে। সেটি নিয়ে বেঞ্চ অফিসার বিষয়টি কোর্টকে জানায়। কোর্ট বিষয়টি আমলে নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।
এদিকে, মামলাটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের নাম উল্লেখ করে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জামিন পেয়েছেন আমিনুর ইসলামসহ ৩০ আসামি। কিন্তু ওই দিন এই কোর্ট থেকে এমন কোনো জামিন আদেশ হয়নি। এমনকি সেখানে আইনজীবীদের যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটিরও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হাইকোর্টের ভুয়া জামিননামা তৈরির বিষয়টি ধরা পড়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, এটা আদালতের সঙ্গে প্রতারণা। আসামিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এটা সম্পূর্ণ জালিয়াতি। একটি চক্র এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠিনতর ব্যবস্থা নিতে হবে।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, এই আদালত কোনোদিনও আগাম জামিনের আবেদন শোনেন না। আর জামিননামায় যেসব আইন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন ২০১৯ সাল থেকে আর অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে নেই। অন্যজন পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, এই কাগজটি সম্পূর্ণ ভুয়া।

তিনি আরও বলেন, এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে গেলে সমাজের কাছে একটি খারাপ বার্তা যাবে। এ কারণেই আদালতে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছি। আদালত তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বগুড়ার আদালতকে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

জানা যায়, গত ৯ ফেব্রুয়ারি বগুড়ায় দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের ছোট ভাই মশিউল আলম বাদী হয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি বগুড়া থানায় মামলা করেন। মামলায় উপজেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি মো. আমিনুল ইসলামসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়।

এ মামলায় হাইকোর্ট থেকে আমিনুল ইসলামসহ ৩০ জনের জামিন নেয়ার একটি আদেশনামা তৈরি করা হয়। সেই আদেশনামায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে আসামিদের ৬ সপ্তাহের জামিন দেয়া হয়েছে বলে দেখানো হয়। এই জামিন শেষে তাদের বিচারিক (নিম্ন) আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়।
হাইকোর্টের এই আদেশের তথ্য সংশ্লিষ্ট আদালতের নজরে আসে। এরপর এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনের বক্তব্য জানতে চান। অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করে জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানান। এরপর আদালত আসামিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।

জামিন জালিয়াতির অন্যতম একটি ঘটনা শাশুড়ি কর্তৃক মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের অর্থ আত্মসাতের মামলা। ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর মেয়ে আকিলা আঞ্জুয়ারা ও মেয়ের জামাই আনোয়ার হোসেন রানাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন দেলওয়ারা বেগম। ওই মামলায় একই বছরের ১১ অক্টোবর আনোয়ার ও আঞ্জুয়ারাকে আগাম জামিন না দিয়ে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুই আসামি আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। ২৫ অক্টোবর বগুড়ার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামিন নামঞ্জুর করে স্বামী-স্ত্রীকে কারাগারে পাঠান। এরপর গত ৩ ডিসেম্বর জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসামিদের জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।
এদিকে নিম্ন আদালতে জামিন আবেদনের খারিজা দেশের বিরুদ্ধে প্রথমে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে জামিন চেয়ে আবেদন জানান ওই দম্পতি। পরে হাইকোর্ট তাদের জামিন প্রশ্নে রুল জারি করেন। রুলের শুনানি শেষ না হতেই আগের আদালতকে না জানিয়ে আসামিরা হাইকোর্টে আরও দুটি পৃথক জামিনের আবেদন করেন। যা আদালতের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

একইসঙ্গে তিন আদালতে আবেদন করার বিষয়টি নজরে আসায় আসামিদের আবেদন সরাসরি খারিজ করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার শাস্তি হিসেবে পরের চার মাস দেশের কোনও আদালতে ওই দম্পতি জামিন চাইতে পারবে না বলেও আদেশ দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘মামলায় জামিনের বিষয়ে রুল জারির পর তা শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। এরই মধ্যে আবারও আবেদন করা হয়েছিল। আদালতে তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে আসামিরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বিষয়টি আমার নজরে আসায় খোঁজ নিতে শুরু করি। পরে ঘটনার সত্যতা পেয়ে আদালতকে জানালে হাইকোর্ট ওই দম্পতির জামিন আবেদন করার সুযোগ চার মাসের জন্য আটকে দেন।

ঠিক একই কারণে গত ২৯ জানুয়ারি ডাকঘরের অর্থ আত্মসাতের মামলায় চট্টগ্রাম ডাকবিভাগের কাউন্টার অপারেটর সারওয়ার আলম খানের জামিন আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ওই আসামির ক্ষেত্রেও চার মাস জামিন আবেদন না করতে পারার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

কয়েকটি মামলার নথি ও ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূলত দ্রুত জামিনে বের হওয়ার আশায় আসামিরা জালিয়াত চক্রের প্ররোচনায় একেকবার একেক আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করে থাকেন।

আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত আসামিকে সরাসরি জামিন না দিয়ে অনেক সময় রুল জারি করেন। রুলের শুনানি পর্যন্ত আসামিকে কারাগারেই থাকতে হয় এবং অন্য কোনও আদালতে আবেদন করার জন্য তিনি বিবেচিত হন না। কারাবন্দি থাকার সময়ই জালিয়াত চক্রের প্রস্তাব পেলে নথি জালিয়াতির সুযোগ নেন আসামিরা। জামিন আবেদন হাইকোর্টের কোনও বেঞ্চ খারিজ করলে সে আদেশের বিরুদ্ধে আপিল না করে অনেক আসামি খারিজের তথ্য গোপন রেখে অন্য কোনও হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। এ নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীদের।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আদালতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করা সম্ভব না হলে এ অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে না। আমরা এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করবো। মামলার এফিডেভিট পদ্ধতি বদলাতে হবে। আসামিদের নাম দিয়েই যেন মামলা এন্ট্রি করা হয়, সে বিষয়ে জোর দেবো।

https://dailysangram.com/post/446431