১০ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৬:১১

ব্যয়বহুল তবুও টেকসই নয়

ভাঙাচোরা দশায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক টেকসই উন্নয়নের বিকল্প খুঁজতে হবে : অধ্যাপক ড. সামসুল হক

বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক বানালেও সেগুলো টেকসই হচ্ছে না। কখনো চালুর আগে আবার কখনো চালুর এক বছরের মধ্যেই ভাঙাচোরা দশায় চলে যাচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। সড়ক টেকসই করার জন্য ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণকাজের গুণগত মান, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পানি নিষ্কাশন-এই চারটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এ কারণে নির্মাণের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেবে যাচ্ছে মহাসড়ক, ফুলেফেঁপে উঠছে, ভেঙে গেছে ডিভাইডার।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোথাও পিচ (পেভমেন্ট) দেবে গেছে। আবার কোথাও ফুলেফেঁপে উঠেছে। ভেঙে গেছে ডিভাইডার। দেশের অন্যতম ব্যয়বহুল এ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে প্রায় ২১ কোটি টাকা। একই সমস্যা দেখা দিয়েছে এ মহাসড়কেও। অতিরিক্ত ব্যয়ের পরও সড়কগুলো টেকসই হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের আগে আমাদের ভাবনায় আনতে হবে পৃথিবীতে কি এই ধরনের রাস্তা আছে নাকি অন্যকিছু আছে? আমেরিকাতে ওভারলোডিংয়ের কোন কথাই আনা যাবে না, সাথে সাথে স্যু হয়ে যাবে। আমাদের এখানে রোডটাকে কন্ট্রোল করার কোন অথরিটি নেই। তিনি বলেন, আমাদের সবকিছু জেনে টেকসই উন্নয়নের একটা বিকল্প খুঁজতে হবে। পুরনো ধ্যান-ধারনার ট্রিটমেন্ট দিয়ে রাস্তা বানানোর পর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে যদি আমরা শিক্ষা না নেই তাহলে আমি বলবো এটা অন্যায় হবে।

এদিকে, সম্প্রতি এ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাতে বলা হয়েছে, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ প্রকল্পেই নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাতীয় সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সা¤প্রতিক এক বৈঠকে এ মূল্যায়নসংবলিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে আইএমইডি। প্রতিবেদনে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় সমাপ্ত ৯৬টি সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়।

আইএমইডির প্রতিবেদনে এসব মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে আরো কিছু সমস্যার কথা উঠে আসে। এগুলো হলো প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, মেয়াদ বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান না করা, ত্রুটিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি), সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু করা, মাটি পরীক্ষা না করা ইত্যাদি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রকল্প পর্যবেক্ষণের পর সেগুলোর ত্রæটি দূর করতে বিভিন্ন সময়ে নানা সুপারিশ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোও আমলে নেয়া হয়নি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের প্রকল্পটি নিয়ে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অত্যধিক সংখ্যক ও অননুমোদিত ভারবাহী যানবাহন চলাচলের কারণে মহাসড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনের জন্য মহাসড়কটির পূর্ণ উপযোগিতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে দ্রুত নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করা প্রয়োজন। তা না হলে দেশের অর্থনীতির প্রধান মহাসড়ক হিসেবে বিবেচিত সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানান, সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণে অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয় পর্যালোচনা করছে আইএমইডি। কারিগরি ও প্রায়োগিক নানান বিষয় এরই মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিকে অবহিত করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সড়কের গুণগত মান বজায় রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর আরো দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাসিক পর্যালোচনা সভাটি আরো দক্ষ ও সঠিকভাবে হওয়া প্রয়োজন। তাহলে সেখানেই অনেক ত্রæটি-বিচ্যুতির সমাধান চলে আসতে পারে। পাশাপাশি পিএসসি ও পিআইসি কমিটিগুলোকে আরো সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একটি মহাসড়কের নকশা প্রণয়নের সময় যেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়, তার অন্যতম হলো ইকুইভ্যালেন্ট সিঙ্গেল এক্সেল লোড (ইএসএএল)। এক্ষেত্রে মহাসড়কটি একসঙ্গে কী পরিমাণ চলাচলরত যানবাহনের চাপ নিতে সক্ষম, সেটিকেই ইএসএএল (এক ইএসএএল = ১৮ হাজার পাউন্ড) এককে প্রকাশ করে থাকেন প্রকৌশলীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের নকশা প্রণয়নের সময় এর ইএসএএল হিসাব করা হয়েছিল ১৩৩ মিলিয়ন। যদিও বর্তমানের গড় ট্রাফিক অনুযায়ী, মহাসড়কটিতে ইএসএএলের মান দাঁড়িয়েছে ১৭৭ মিলিয়নে, যা প্রক্ষেপণের চেয়ে অনেক বেশি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নকশার তথ্য অনুযায়ী, মহাসড়কের সবচেয়ে নিচের ধাপটি বালিনির্মিত। ইমপ্রুভড সাব গ্রেড নামে পরিচিত ধাপটির পুরুত্ব ৩০০ মিলিমিটার। এর ওপর দ্বিতীয় ধাপে ইটের খোয়া ও বালির মিশ্রণ থাকার কথা ১৫০ মিলিমিটার পুরুত্বের। নকশায় পাথর দিয়ে গড়া পরের ধাপের পুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫০ মিলিমিটার। প্রকৌশলীদের ভাষায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ দুটিকে একত্রে বলা হয় সাব বেজকোর্স। সাব বেজকোর্সের ওপরে থাকে এগ্রিগেট বেজ। মহাসড়কটির নকশায় পাথরে নির্মিত চতুর্থ ধাপের এ বেজটির পুরুত্ব ধরা হয়েছে ৪০০ মিলিমিটার। এর পরের দুটি ধাপে ব্যবহার করা হয় বিটুমিন। এর মধ্যে নকশায় বিটুমিনাস বাইন্ডার্স কোর্স নামে পরিচিত ধাপটির পুরুত্ব রাখা হয়েছে ১০০ মিলিমিটার। সর্বশেষ ধাপ বিটুমিনাস ওয়্যারিং কোর্সের পুরুত্ব রাখা হয়েছে ৬০ মিলিমিটার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের নকশা প্রণয়নের সময় ধরে নেয়া হয়েছিল, এতে প্রতি বছর গাড়ি চলাচল বাড়বে ৬ শতাংশ হারে। যদিও সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের নির্দেশিকায় সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে যানবাহন চলাচলে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হারে প্রাক্কলনের নির্দেশনা রয়েছে। বাস্তবে দেখা গেল, চালুর পর চার লেনের মহাসড়কটিতে গাড়ির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি। এতে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা দিয়েছে রাটিং। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়কের ভিত। এতে করে মহাসড়কটি সংস্কারেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। এজন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ২০ বছর মেয়াদি ‘দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১): রূপকল্প ২০৪১’। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, ২০৪১ সালে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ ডলার, দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে ৫ শতাংশে। কিন্তু অর্থনীতির এসব লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণ হচ্ছে না সড়ক-মহাসড়ক। পরিকল্পনার ভুলে আর অদূরদর্শিতায় সরকারের অর্থনৈতিক লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো।

উন্নত অর্থনীতির পথে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহন যে হারে বাড়বে তার জন্য প্রয়োজন হবে ছয় থেকে আট লেনের মহাসড়ক। অথচ বাংলাদেশ এখনো চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, এসব নির্মিত মহাসড়কের মানও ভালো নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সড়ক বাংলাদেশে। উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হওয়ার পথে থাকা অন্য দেশগুলো সড়ক অবকাঠামোয় যেভাবে এগিয়ে, সে তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের যোগাযোগ অবকাঠামো সূচকে সিঙ্গাপুরের অবস্থান পাঁচ নম্বরে। একই সূচকে মালয়েশিয়ার অবস্থান ৩৩, থাইল্যান্ড ৪১ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ আছে ৭২ নম্বরে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাও বাংলাদেশের উপরে আছে। সূচকে ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে সমন্বিতভাবে। তারা আধুনিক রেল যোগাযোগ যেমন গড়ে তুলেছে, তেমনি নৌপথকেও কাজে লাগিয়েছে। প্রশস্ত রাস্তা বানিয়ে সড়ক যোগাযোগও নির্ভরযোগ্য অবস্থানে নিয়ে গেছে। উন্নত দেশগুলো তাদের যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলেছে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব করে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। উন্নত দেশগুলো প্রশস্ত, মজবুত ও সুশৃঙ্খল রাস্তা গড়ে তুলেছে। আর আমরা কেবল গড়ে তুলছি চার লেনের রাস্তা।

https://www.dailyinqilab.com/article/363933