১০ মার্চ ২০২১, বুধবার, ৫:৪২

চার বছরে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই চার বছরের অডিট রিপোর্টে মোট ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকাই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের। অর্থাৎ আর্থিক অনিয়মের ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। পাশাপাশি বিগত ৯ বছরে ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ গুণ। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর অডিট রিপোর্টের এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়মের সঙ্গে দায়ীদের বিচারের আওতায় না আনার সংস্কৃতি আর্থিক খাতে অনিয়ম বাড়াতে সহায়তা করছে। অবশ্যই এটি সরকারের জন্য একটি সতর্ক বার্তা।

সিএজি’র রিপোর্ট বলছে, আর্থিক অনিয়ম তীব্র গতিতে বেড়ে চলেছে। বর্তমান সরকারের সময়ে ২০১৩ সালে ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছিল ৬৫২ কোটি টাকার। ২০২১ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত ৯ বছরে ব্যাংক খাতে আর্থিক অনিয়মের হার বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৬ গুণ। সিএজি বলছে, সরকারি অর্থের অনিয়মের ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশ হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। আর ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই চার বছরের অডিট রিপোর্টে মোট ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকাই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালের সিএজির রিপোর্টে মোট ২৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের পরিমাণ ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের রিপোর্টে মোট অনিয়ম চিহ্নিত করা হয় ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকাই হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। একইভাবে ২০১৯ সালে সিএজির রিপোর্টে অনিয়ম উঠে আসে ১১ হাজার ৭১০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাতের। একইভাবে দেখা গেছে-২০১৮ সালে যে রিপোর্ট করা হয়, সেখানে মোট আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়েছিল ১১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম হচ্ছে ৮ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এসব অনিয়মের মধ্যে ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এছাড়া বেসিক ব্যাংক থেকে চলে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম প্রসঙ্গে সিএজির প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ও ঋণ শোধের যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া বন্ধকি নিয়ে ঋণ দেওয়া হয়েছে। ভুয়া জমি, সরকারি খাসজমি মর্টগেজ রেখে ও বন্ধকি জমি আইনজীবী কর্তৃক ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পরও গ্রাহককে ঋণ দেওয়া হয়। এছাড়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, ঋণ শোধের যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠানকে ভুয়া বন্ধকি নিয়ে ঋণ ইস্যু করা হয়েছে।

পাশাপাশি পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ বিতরণ, শ্রেণীকৃত দায় থাকার পরও ত্রুটিপূর্ণ সহায়ক জামানতের বিপরীতে এবং গ্রাহকের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ঋণ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঋণ শেষ পর্যন্ত খেলাপিতে রূপ নেয়। সেখানে আরও বলা হয়, অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ ইস্যু ও নিয়ন্ত্রণহীন এলাকার বাইরে তড়িঘড়ি করে ঋণ মঞ্জুর, শাখার আপত্তি উপেক্ষা ও বন্ধকি সম্পত্তি মূল্যায়ন ছাড়া ঋণ ইস্যু, মঞ্জুরি শর্ত অমান্য করে অনিয়মিতভাবে ওডি ঋণ দেওয়া হয়। এমন অসংখ্য অনিয়মের ঘটনা ঘটছে ব্যাংকিং খাতে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অধিকাংশ অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন, আর্থিক বিধিবিধান ও সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ের আদেশও অমান্য করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার কারণে এমনটি হয়েছে। ব্যাংকে অনিয়ম তখনই বেশি হয়, যখন ব্যাংক কর্মকর্তারা দুর্নীতি করতে উৎসাহ পান। অথবা অনিয়ম করলে শাস্তি হয় না। তার মতে, প্রভাবশালীরা চাপ দিলেও অনিয়ম করে ঋণ দেওয়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের উচিত নয়।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, ব্যাংক গুলোতে অনিয়ম বৃদ্ধির প্রথম কারণ হচ্ছে, বিগত সময়ে অনিয়ম ও দুনীর্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি অনিয়ম হয়েছে, কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনিয়মের সঙ্গে দায়ীদের বিচারের আওতায় না আনার সংস্কৃতি আর্থিক খাতে অনিয়ম বাড়াতে সহায়তা করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিএজির আর্থিক অনিয়ম রিপোর্টগুলো গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করা দরকার। সংশ্লিষ্টদের কাছে এর জন্য জবাব চাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি পর্যালোচনা করে এই অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম বেড়েছে, এতে সন্দেহ নেই। দুঃখজনক হচ্ছে-খেলাপি ঋণ না দেখিয়ে তা মুছে ফেলার সক্রিয় প্রায়াস চলছে। এতে অনিয়মে খেলাপি ঋণ বাড়লেও সেটি লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে। গত নয় বছরে ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের পরিমাণ বেড়েছে ১৬ গুণ। এটি অবশ্যই সরকারের জন্য একটি সতর্ক বার্তা।

 

https://dailysangram.com/post/446127