৯ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৫০

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চায় প্রায় সবাই

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : সাম্প্রতিক সময়ে একটি খবর দেশ-বিদেশের অনেককে নাড়া দিয়েছে, আর সেটা হল কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হয়ে তিনি প্রায় ১০ মাস কারাবন্দী ছিলেন, তার জামিনের আবেদন আদালত ছয় বার প্রত্যাখ্যান করে। এই আইনে সবচেয়ে বেশী ভুক্তভোগী সাংবাদিক এবং মুক্ত মনের লেখকরাই। খবরে প্রকাশ, করোনাভাইরাসকালীন সময়েও এই আইনে দুইশ এর বেশী মামলা হয়েছে। সিনিয়র বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এখনো কারাগারে রয়েছেন। আইনটি কার্যকর হবার আগে ও পরে এটি বাতিল অথবা সংশোধনের জন্য সর্বমহল থেকে দাবি জানানো হলেও এতে সরকারের টনক নড়েনি। বরং এই আইনের অপব্যবহার বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-এর মত একটি কালো আইন তৈরি করেছে। যাতে সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে ভয় পায়, আর যদি কেউ বলেও ফেলে তাহলে তার অবস্থাও লেখক মুশতাক কিংবা কার্টুনিস্ট কিশোরের মতোই হবে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল ১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ৪৫৭ জনের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে নওগাঁর মান্দা থেকে সুলতান মাহমুদ সরকার বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কী মেসেজ পাচ্ছে? বাংলাদেশে কি মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে? এই মৃত্যু থেকে একটা ম্যাসেজ তো আছেই। তবে এই মুহূর্তে মেসেজটা খুব একটা সুখকর না। দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে মেনহাজুল ইসলাম তারেক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে আটকাবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু আমার মনে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। আইনটি প্রণয়নের সময় থেকেই মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তমনা মানুষরা এই আইনের বিরোধিতা করে আসছিলো। সবার শঙ্কা ও উৎকণ্ঠাকে সত্য প্রমাণিত করে অনবরত সেই আইনের অপব্যবহার চলছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ঢাকার ধানমন্ডি থেকে শামীম উদ্দিন শ্যামল বলেছেন, এই আইন নিয়ে প্রথম থেকেই লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশকের আপত্তি ছিল। তার একটাই কারণ, এই আইনের অপপ্রয়োগ করে স্বার্থান্বেষী মহল স্বার্থ লুটবে। আর তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে গত দুই বছরে এই আইনের অপপ্রয়োগ দেখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেছেন, এই আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক নিরপরাধ সাধারণ নাগরিক শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে বলির পাঠা হচ্ছে।

সূত্র মতে, ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিভায় প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ অনুমোদিত হওয়ার পর দেশ-বিদেশে এই আইনের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে ২০১৬ সালে এই আইন প্রস্তাব হিসেবে উপস্থাপনের পর যেসব সমালোচনা হয়েছিল, বিভিন্ন বৈঠকে যেসব নেতিবাচক দিক চিহ্নিত করা হয়েছিল, সরকার কার্যত সেগুলো আমলে নেয়নি। যৎকিঞ্চিৎ যে সংশোধন বা পরিবর্তন হয়েছে, তাতে এই আইনের উদ্দেশ্য বা মর্মবস্তুর কোনো বদল ঘটেনি বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা।

এই আইনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আলোচনায় যে বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তা হচ্ছে কী করে এই আইন দেশে সাংবাদিকতার জন্য এক বিরাট প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হবে। এ প্রসঙ্গে কুখ্যাত আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বিভিন্ন বিষয়কে ৪টি ভাগে ভাগ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারায় (ধারা ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১) সংযুক্ত হওয়ার বিষয় বিস্তারিতভাবেই আলোচিত হচ্ছে। নতুন আইনের ৩২ ধারা এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। এই ধারার একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতিরেকে সরকারি তথ্য সংগ্রহ করলে তাকে গুপ্তচরবৃত্তি বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। ফলে এই আইনের ভেতরে এমন ব্যবস্থা রেখে দেয়া হয়েছে, যা কেবল শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিরুদ্ধেই নয়, কার্যত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পথকেই প্রশস্ত করেছে। অনুমোদিত খসড়ায় এই আইনের আওতায় সরকারি তথ্য সুরক্ষার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে যে জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়নি, সেটা সহজেই বোধগম্য। যে দেশে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করার পর সবাই উৎফুল্ল হয়েছিল, সেই দেশে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এত দিন ধরে যে আইসিটির ৫৭ ধারা বজায় ছিল, সেটাই ছিল মর্মান্তিক, দুর্ভাগ্যজনক। কয়েক দিন ধরে আবারো আলোচনা সমালোচনায় এই আইনের প্রত্যক্ষ এবং আশু যেসব প্রতিক্রিয়া পড়বে বলে বলা হচ্ছে, এর অধিকাংশই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপরে। কিন্তু এই আইনের ভার কেবল যে সাংবাদিকদেরই বইতে হবে, তা নয়। বাংলাদেশ বিষয়ে যারা গবেষণা করেন, বিশেষত যারা ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য এই আইনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা তাদের উদ্বিগ্ন করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের গবেষক বা শিক্ষকদের মধ্য থেকে এমন কোনো শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

২০২০ সালের মে মাসে সম্পাদক পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনের অস্ত্র হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের শঙ্কা ‘এখন গণমাধ্যমের জন্য দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে’। গত শনিবার সংগঠনটি আরেকটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে তারা আবারো বলেছে, আশঙ্কার চেয়েও কঠিনভাবে প্রয়োগ হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার সব সাংবাদিক ও লেখকের মুক্তি এবং মামলা প্রত্যাহার দাবি করেছে। সেই সঙ্গে আইনমন্ত্রী এই আইনটি পর্যালোচনা করার যে কথা বলেছেন তা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অবিলম্বে কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে। ১০ মাস কারাবন্দী থাকার পর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে জামিন দেওয়ায় আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ‘নিখোঁজ’ হওয়া এবং পরে দীর্ঘ কারাবাস সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়ে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি লেখা শেয়ার দেয়ার কারণে সাংবাদিক কাজলকে দীর্ঘদিন নিখোঁজ ও কারাগারে থাকতে হয়েছে। পরে জামিন পেলেও তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলমান রয়েছে। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কাজলকে মামলা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পরিষদ আরও বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি, মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, সংসদে বিল উত্থাপন ও রাষ্ট্রপতির সইয়ের আগে ও পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সম্পাদক পরিষদ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা আপত্তি তুলেছিল। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, সেগুলো বিবেচনায় নেয়া হলে আজকের এ পরিস্থিতি হয়তো উদ্ভব হতো না।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো, এ আইনের অপরাধ ও শাস্তিসংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য, পাঁচটি জামিনযোগ্য এবং একটি সমঝোতাসাপেক্ষ। এর ফলে অনিবার্যভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক অনুশীলন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারা বলছেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করবে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু, কৌশলে তা যেন গণমাধ্যম ও মুক্তমনের লেখকদের ওপর প্রয়োগ করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে অনতিবিলম্বে আইনটির সংশোধন করতে হবে।

জানা গেছে, ডিচিটাল আইনের দুঃস্বপ্নের সূচনা হয়েছিল এই আইনের খসড়া তৈরি থেকেই। সরকার ও তার সমর্থকদের অপছন্দ হলে জামিনঅযোগ্য ধারায় মামলা হচ্ছে, পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করছে। অনেক ক্ষেত্রেই আটকের পরে এই ধারায় মামলা করা হচ্ছে। একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সাদাপোশাকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার পর আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে। এই আইনের কতটা ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে, তা বোঝা যায় আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল ১৯-এর সংগ্রহ করা তথ্যে। তাদের হিসাবে গত জানুয়ারি থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এই আইনে মামলা হয়েছে ১১১টি, অভিযুক্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২০৫ জন, আটক হয়েছেন ১১১ জন। আরেকটি হিসাবে বলা হচ্ছে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এখন প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মামলা হচ্ছে (২৬ জুন ২০২০)। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন জামিন পেয়েছেন, তার পুরো হিসাব নেই।

সম্প্রতি ফের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জোর দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ২৭ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, একই মামলায় অন্য অভিযুক্তরা জামিন পেলেও ছয়বার আবেদন করা সত্ত্বেও মুশতাক আহমেদের জামিন না হওয়া, প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার নামে দিনের-পর-দিন জেলখানায় আটকে রাখা এবং রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যুকে সরকার আর ৮-১০টি ঘটনার মতোই বিবেচনা করছে। এক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা ব্যক্তিবিশেষ দূরভিসন্ধিমূলকভাবে অপব্যবহার করছে কিনা? সে সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে, এমন আশা প্রায় অলীক। যদিও এমন মর্মান্তিক ঘটনার কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিতে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও তার অপব্যবহারই যে মুশতাকের মৃত্যুর কারণ, এ কথা সরকার কীভাবে অস্বীকার করবে? গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ৪৫৭ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে ১৯৭টি মামলা হয়েছে, যেখানে ৪১টি মামলায় ৭৫ জন পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই আইনের করা মামলার অধিকাংশেরই বাদী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয় তো ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী।

বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভীষণ অস্পষ্ট এবং সরকারের সমালোচনা ঠেকাতেই এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনটাই দাবি করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ররি মুঙ্গোভেন। ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং সেটি সরকারের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। মুঙ্গোভেন বলেন, এই আইনের অনেক ধারাই সিভিল সোসাইটির কণ্ঠরোধ, সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচদের জন্য ব্যবহার করা যায়। তিনি যুক্ত করেন, আমরা করোনা মহামারির সময় দেখেছি এই আইনের ব্যপক ব্যবহার হয়েছে। গত বছর প্রায় ১৪০টিরও বেশি মামলা করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা সরকারের নীতির সমালোচনা করেছেন, সমালোচনা করেছেন মহামারি মোকাবেলা সংক্রান্ত দুর্নীতির। অথচ এই আইনের আসল উদ্দেশ্য এটি ছিলো না। তার মতে, এই আইনে এমন সব সাজা রাখা হয়েছে যা অস্বাভাবিক।

এ বিষয়ে প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আইনমন্ত্রী বলেছেন এখন থেকে তদন্ত করে ডিজিটাল আইনে মামলা করা হবে। এতদিন ধরে ডিজিটাল আইনে ঢালাওভাবে সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। এমনকি এই আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন, তার দায়ভার কে নেবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থী। গণমাধ্যমের হুমকিস্বরূপ। তাই আমি আগেও বলেছি, এখনো বলছি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করছে বিধায় অবিলম্বে এই কালো আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আইন তো জনগণের জন্যই। বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। সংশোধন প্রয়োজন।

আইন ও সংবিধান বিশেজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট অপরাধ সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের আইন দরকার। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে সেই আইনে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া সংক্রান্ত ধারা থাকতে পারে না। তা হলে সেই আইনের অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার হতে বাধ্য। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৯ ও ৩০ এই পাঁচটি ধারা অবিলম্বে বিলোপ করতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে ধারাগুলো মানুষের মুক্ত চিন্তার অধিকার এবং বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ভিন্নমত দমনে অপব্যবহার হচ্ছে আমরা সেই ধারাগুলো পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওই ধারাগুলো সংশোধন করার জোর দাবি জানাচ্ছি। অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন জরুরি হয়ে পড়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, লেখক মুশতাক আহমেদকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গ্রেফতার করে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক রেখে হত্যা করা হয়েছে।

আমরা প্রথমেই বলেছিলাম যে, এই হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়েছে। ফখরুল আরও জানান, এই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে প্রায় সাতশ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আপনারা দেখেছেন ইতিপূর্বেও শুধু সরকারের সমালোচনা বা কার্টুন বা লেখার কারণে পাঁচ বছরে গৃহবধূ থেকে শুরু করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, এই সরকার সম্পূর্ণ একটা অবৈধ সরকার, অনির্বাচিত সরকার। তাদেরকে জোর করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হচ্ছে এবং টিকে থাকার জন্য এই ধরনের সম্পূর্ণ গণবিরোধী আইন তৈরি করেছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গণফোরাম সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।

চারদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি উঠলেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের কোনো পরিকল্পনা যে এখন সরকারের নেই। তবে এ আইনের ‘অপব্যবহার বা দুর্ব্যবহার’ কীভাবে বন্ধ করা যায়, সরকার সেই চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ডিজিটাল জগতে বাংলাদেশে সবাইকে সুরক্ষিত রাখতেই এই আইন। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন গড়েছি, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা দেয়াও আমাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্বটাও আমাদের পালন করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/446067