৯ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:২০

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা

ড. মো. নূরুল আমিন : অব্যাহত প্রাকৃতিক বিপর্যয়- ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, ভূমিধ্বস ও ক্ষিপ্র ও তীব্র দারিদ্র্য প্রভৃতি যেখানে নিত্যসঙ্গী সেখানে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিশ্বের অনেককেই বিস্মিত করেছিল। তাদের আশংকা ছিল অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে এই দেশটি আসলে কি টিকবে। এই আশংকার সামনে আশার একটি আলোকবর্তিকা তারা দেখতে পেয়েছিলেন সেটা হচ্ছে, প্রায় একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটি জনশক্তি যাদের ভাষা এক, ৮ শতাংশ লোক ছাড়া বাকি সবার ধর্ম ও সংস্কৃতি এক এবং একশ’ শতাংশ লোকেরই অভ্যাস ও জীবনযাত্রা এক। তাদের বর্ণ ও আকৃতিও প্রায় একই রকম। এই একক বৈশিষ্ট্যটি উন্নয়নের একটি অনুপম উপাদান। রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রায় শতকরা একশ’ ভাগ লোকই যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলে অথবা বাংলা ভাষা বুঝে সেখানে উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য যে কোনও ম্যাসেজ তাদের মধ্যে সহজে ও দ্রুত গতিতে পৌঁছিয়ে দেয়া সহজ। এতে শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির বিচ্ছুরণ ত্বরান্বিত হয়। স্বাধীনতার প্রারম্ভে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ থাকলেও বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের বিপুল সম্ভাবনা বিদ্যমান ছিল।

আজ ৫০ বছরের মাথায় উপরোক্ত দু’টি বিষয়ে নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা জাতীয় ঐক্যের সূত্রটি এখন আর কাজ করছে না বলে মনে হয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শুরু থেকে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে কৃষি খাতের উপর সকল সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে আসছে। জাতীয় কৃষি নীতি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে কৃষি খাতের সঠিক উন্নয়ন কৌশল নির্ধারিত হয়েছে। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিলো ৩ কোটি ৬৫ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় এর পরিমাণ ছিল মাত ৯১ লাখ টন। বৃদ্ধির হার চার গুণেরও বেশি। কৃষি খাতের এই অগ্রগতি বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সমৃদ্ধ একটি দেশে রূপান্তরের পথে মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি বাংলাদেশে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একটি বিপ্লব সাধিত হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশে মোট ৩৩.৮১ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। একইভাবে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির গোশত ও ডিমের ক্ষেত্রে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি স্বাধীনতা-উত্তর সরকারসমূহ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য শিল্পায়নের উপর প্রয়োজনীয় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিবিএস’র সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে জিডিপিতে এই খাতের অবদান ছিল ৩৪.১৪ শতাংশ। জাতীয় শিল্পায়ন নীতি নারীর উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাসহ নারীদেরকে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার মূল ধারায় নিয়ে আসাসহ দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এই উদ্দেশ্যে যেখানে সম্ভব সেখানে পুঁজিঘন শিল্পের পরিবর্তে শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। শিল্প খাতের বিকাশের জন্য রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসমূহ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে। এসব অঞ্চলে বিনিয়োগ ও রফতানি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এটা অত্যন্ত আশার কথা যে, বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৩ শতাংশ মানুষ নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। দেশে বর্তমানে মোট স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ১৮০৭১ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ক্যাপ্টিভসহ ২১১৭৯ মেগাওয়াট। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস দেশে মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি চাহিদার ৭১ শতাংশ পূরণ করে। এ যাবত আবিষ্কৃত ২৭টি গ্যাস ক্ষেত্রের ক্রম পুঞ্জিত গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৫.৯৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং উত্তোলনযোগ্য নীট মওজুত ১১.৯২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। দেশের জ¦ালানি তেলের মওজুত ক্ষমতা প্রায় ১৩.২৭ লক্ষ মেট্রিক টন।

পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর মোট প্রায় ২১৫৬৯ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। বাংলাদেশে মোট রেল পথের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ২১৫৫.৫৩ কি মি, নৌ পথের নাব্য সংরক্ষণ, নৌপথ উদ্ধার, নিরাপদ নৌযান চলাচল নিশ্চিতকরণ, অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরসমূহের উন্নয়ন, নৌপথের অবকাঠামো সৃষ্টি এবং বন্দর উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান গড়ে বছরে প্রায় ২৫.৮৮ লক্ষ যাত্রী এবং ৩০৯৭০ টন কার্গো পরিবহন করে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানব সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের বরাদ্দকৃত বাজেটের গড়ে ২২.০৯ শতাংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশু, সমাজকল্যাণ যুব ও ক্রীড়া সংস্কৃতি, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রভৃতি মন্ত্রণালয় ব্যয় করে। স্বাস্থ্য-পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে নেয়া অগ্রধিকারভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। দেশে প্রজনন ও মৃত্যু হার কমেছে। গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ নবজাত শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছি। Human Development Report 2018 অনুযায়ী বিশ্বের ১৮৯ টি দেশের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬ তম।

দারিদ্র্য বিমোচন এবং ক্ষুদ্র ঋণ দাদন ও আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সফল দেশ হিসেবেও সারা বিশ্বে সুপরিচিত।
তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিপুল সাফল্য সত্ত্বেও সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশেষ করে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, সুশাসন সম্পদের সুষম ও ন্যায্য বণ্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতা বিশ্ব দরবারে দেশটির মর্যাদাকে হেয় করে রেখেছে। যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই সুকৃতিগুলো এখন বাংলাদেশে অনুপস্থিত। দেশে জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজন ও প্রতিহিংসার রাজনীতি বিরাজ করেছ। দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে দল ও গোষ্ঠী প্রেমের সংকীর্ণ গণ্ডিতে।

উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। তিনি সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানি ভুলে ঐক্যবদ্ধ হবার ডাক দিয়েছেন।
আসলে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে যে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করার সকল গুণ বাংলাদেশের আছে। এর সাথে যদি জাতীয় ঐক্য, সুশাসন ও সততা, নিষ্ঠা এবং আদর্শ যোগ হয় এবং দেশে আমরা গণতন্ত্র ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হই তা হলে বিশ্ব দরবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো আমাদের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। আমরা আমাদের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাবো এটাই আমাদের কামনা।

https://dailysangram.com/post/446055