৮ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১১:৪৭

রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে

মুহাম্মদ নূরে আলম : রাজধানী ঢাকা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। চাহিদার জোগান দিতে অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় এর স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এ কারণে এখন ওয়াসার বসানো বেশিরভাগ পাম্পে ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পাম্পের পাইপ আরও গভীরে নিতে হচ্ছে। পানি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এর পরিণাম ভোগ করতে হবে। এভাবে পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে একসময় শুধু পানির অভাবেই ঢাকা ছাড়বে মানুষ। তাই ঢাকাকে বাঁচাতে হলে নদীর পানি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। আর উদ্ভিদবিদরা বলছেন, এটি নগরীর গাছপালার জন্যও সুখবর নয়। রাজধানী ঢাকার মাটির নিচের পানির স্তর বিপজ্জনক হারে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ ব্যাপক হারে বসানো ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য ঢাকা ওয়াসা ২০০৯ সাল থেকেই মাটির নিচের পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর কথা বলে আসছিল। কিন্তু অনেক আগে শুরু হওয়া সায়েদাবাদ শোধনাগারের দ্বিতীয় পর্ব চালু ছাড়া নতুন শোধনাগার হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীতে প্রতিবছর গড়ে তিন মিটার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপ বেশি স্থাপন ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের সময় ঝুঁকি বাড়ায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ৯ বছরে রাজধানীতে ওয়াসার ৪৮২টি গভীর নলকূপ ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১৯টিতে। এইসব নলকূপের পেছনে ৫৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়। এগুলো এবং দুটি শোধনাগার থেকে প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২৪৫ কোটি লিটার পানি।

২০১২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সায়েদাবাদ দ্বিতীয় পর্ব চালুর পর কমপক্ষে ১৭ কোটি লিটার পানি উদ্বৃত্ত থাকার কথা প্রচার করে ওয়াসা। ওই সময়ে সিদ্ধান্তও নেয়া হয়, পানির অপচয় কমাতে ৭০টি পাম্প বন্ধ রাখা হবে। বিশেষ করে সায়েদাবাদের পানি যেসব এলাকাপথে সরবরাহ হয়, সেসব এলাকার পাম্প বন্ধ করে সাশ্রয় করা হবে। যেমন ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার এলাকা, শ্যামলী, কল্যাণপুর, নতুনবাজার ও মিরপুর বাঙলা কলেজ এলাকা।

২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসার ‘ঘুরে দাঁড়াও’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তখন তাকসিম এ খান ঘোষণা দেন, ঝুঁকি কমাতে মাটির নিচের পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ (নদী) পানি শোধন করা হবে। ওই সময়ে তিনি হিসাব দিয়েছিলেন যে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৮৩ শতাংশই ভূগর্ভস্থ। আর ১৭ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি। এটাকে উল্টো করে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সায়েদাবাদ শোধনাগারের দ্বিতীয় পর্ব চালুর কারণে এ ক্ষেত্রে মাত্র ৯ শতাংশ উৎপাদন যোগ হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র জলসংকট। রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। যে কারণে ভবিষ্যতে এখানকার পানিতে সমুদ্রের লবণজল চলে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওয়াটার এইড জানাচ্ছে, সুপেয় পানি পাচ্ছেন না দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। উপকূলীয় অঞ্চলে এখনই ১০ কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।

কয়েক বছর আগে বিএডিসির এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢাকার ভূ-স্তরের উচ্চতা ৫০ ফুট। সেই হিসাবে ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় মাটির নিচ থেকে অব্যাহতভাবে পানি তোলা হলে আগামীতে ঢাকার পানিতে সমুদ্রের লবণ পানি চলে আসবে। সংস্থাটি সরকারকে সতর্ক করে জানিয়েছে, এখনই ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় শিল্প ও সেচ কাজের জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তোলা বন্ধ করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে একসময় শুধু পানির অভাবেই ঢাকা ছাড়বে মানুষ।

পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আশ্রাফ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে নতুন কোনও অগ্রগতি নেই, বরং দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে আশার দিক হচ্ছে, ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এটি যদি বাস্তবায়ন না করা হয় তাহলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে। এজন্য নগরবাসীকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।

তিনি আরও বলেন, গবেষণা অনুযায়ী প্রতিবছর কমপক্ষে এক মিটার করে ভূগর্ভস্থ নিরাপদ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। তাছাড়া ঢাকার আশপাশের নদীগুলো অতিমাত্রায় দূষিত হয়ে পড়ায় নদীর পানি নগরীর বাসাবাড়িতে পরিবেশনের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ করা যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে পানি সঠিক মাত্রায় নিরাপদ করা যাচ্ছে না। এছাড়া এই দূষিত পানির প্রভাব পড়ছে ভূগর্ভস্থ পানিতেও।

তিনি জানান, ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ায় পরিবেশ বা গাছপালার কোনও ক্ষতি হয় কিনা, সে বিষয়ে এখনও কোনও গবেষণা হয়নি। তবে মাটি যখন পানিশূন্য হয়ে পড়বে তখন পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা তো থাকবেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয় সেই শূন্যস্থান স্বাভাবিক নিয়মেই পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু নগরীতে কংক্রিটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় খোলা স্থান ঢেকে যাচ্ছে। যে কারণে বৃষ্টির পানি মাটি শোষণ করে নিতে পারছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ শূন্যস্থানও পূরণ হচ্ছে না। ফলে ভূগভর্স্থ পানিও কমছে। আগে থেকেই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিমাত্রায় নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে।

২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরই তাকসিম এ খান সাংবাদিকদের কাছে বলেছিলেন, গভীর নলকূপ কম বসিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানো হবে। অথচ বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে প্রায় ৯ বছরে ঢাকায় ৩৩৭টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, নতুন ৩৩৭টি গভীর নলকূপ বসাতে এবং এগুলোর পাম্প স্টেশন বানাতে ৯ বছরে প্রায় ৫৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এগুলোর পেছনে খরচ হচ্ছে গড়ে ১৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া ওয়াসার মোট ৮১৯টি পাম্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎবিল বাবদ প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। ২০১০-১১ সালে একটি গভীর নলকূপ বসাতে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা খরচ হতো। পাম্প স্টেশন স্থাপনে এর সঙ্গে আলাদাভাবে যোগ হতো আরও অন্তত ২০ লাখ টাকা। এখন একটি গভীর নলকূপ বসাতেই ১ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে। এর সঙ্গে পাম্প স্টেশন তৈরিতে মোট প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ হয়। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় নলকূপ বসাতে গিয়ে এলাকাভেদে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত পাইপ নিয়ে যেতে হয়। আগে যদি ৫০০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, এখন যেতে হচ্ছে ১ হাজার ফুট গভীরে। ভূগর্ভের পানি নিচে নেমে যাওয়ায় তারা এখন নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৭০ ভাগ ভূগর্ভস্থ আর ৩০ ভাগ ভূ-উপরিস্থ। ২০২১ সালের মধ্যে এই চিত্র উল্টে যাবে। এ জন্য এখন পদ্মা ও মেঘনা থেকে পানি এনে তা শোধন করে সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) একেএম সহিদ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে দৈনিক ২৪৫-২৫২ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে উত্তোলন হচ্ছে প্রায় ২৫৫ কোটি লিটার। আমরা চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন করছি। তবে এর বেশিরভাগ পানি আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে আমাদের ৩টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২১ সালের মধ্যে ভূগর্ভের পানি উত্তোলন অনেক কমে আসবে।
ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া গাছপালার জন্য খুব একটা বিপদ না হলেও সুখবর নয় বলে মনে করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ বোটানি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, পানির বেশ কয়েকটি স্তর আছে। কোনও কোনও এলাকায় ৪-৫ ফুট নিচে গেলেও স্তর পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও ৮-১০ ফুট। আবার কোথাও ২০-৪০ ফুট গেলেও পানি পাওয়া যায়। এখন আমাদের ঢাকার ভূগর্ভস্থ যে পানির স্তর রয়েছে, সেটি ১০০ থেকে ৩০০ ফুট নিচে চলে গেছে। আগে ১০০ ফুট নিচে গেলেও পানি পাওয়া যেতো। আর ভালো পানি পেতে হলে ৭০০-৮০০ ফুট পর্যন্ত নিচে যেতে হয়।

ঢাকা ওয়াসা বলছে, ঢাকা মহানগরে তাদের বসানো গভীর নলকূপের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার পেরিয়েছে। আর বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজারের মতো। এই বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির নিচ থেকে দিনরাত অবিরাম পানি তোলা হচ্ছে। রাজধানীতে গভীর নলকূপের বাইরে আছে পাঁচটি পানি শোধনাগার, যেগুলো থেকে মোট চাহিদার ২২ শতাংশ পূরণ হচ্ছে। কিন্তু শোধনাগারের পানির উৎপাদন খরচ ভূগর্ভস্থ পানির উৎপাদন খরচের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। তা সত্ত্বেও আমাদের গভীর নলকূপের ওপর নির্ভরশীলতা দূর করতে হবে। ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা দুই দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর ফলে আমরা গুরুতর সঙ্কটে পড়ে যেতে পারি। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য ক্ষুণ্য হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। উভয় প্রকার ঝুঁকির কথা সবারই জানা আছে। সেজন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয় সব দেশেই।

https://dailysangram.com/post/445962