৭ মার্চ ২০২১, রবিবার, ১১:৩৪

আত্মহত্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে

# করোনাকালে দেশে ১১ হাজারের বেশি মানুষের আত্মহত্যা
নাছির উদ্দিন শোয়েব : করোনা মহামারির মধ্যেও দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে আত্মহত্যা। সমাজে অবমূল্যায়ন, ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া, চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়া, পরিবারের ভরণ পোষণের খরচ যোগাড় ও মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতায় হতাশা ও বিষণ্নতার কারণে আত্মহত্যা বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গত তিনদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীসহ চারজন আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ‘আমার বেঁচে থাকার জন্য কোনো ইচ্ছা নেই’ এমন চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেছেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা কেরেছ এক কিশোর। ভোলায় এনজিওর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক গৃহবধূ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এক নারী ব্যাংকার। এছাড়া গতকাল রোববার রাজধানীর খিলক্ষেতে মারিয়া আক্তার খুশি (১৯) নামের এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী জানিয়েছেন, দেশে চলমান মহামারীর মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মানুষের মৃত্যু পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে সেই সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর চলমান এক জরিপে চলতি অর্থবছরের দশ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মানুষ বুদ্ধি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিষন্নতার চরম পরিণতি হচ্ছে আত্মহত্যা। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতাও কমে আসবে। সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, পরকীয়া সমস্যা, যৌতুক এসব কারণে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে পরিকল্পনা করেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) সূত্রে জানা গেছে, মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ১ হাজার ৫৮ জন মানুষ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই নয় মাসে এ সংখ্যা ছিল ৯৪০। অর্থাৎ করোনার নয় মাসে আত্মহত্যার হার ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। আর ২০১৭ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৬ জন। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করছেন। যাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছে।
চিরকুট লিখে চবি শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রসায়ন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাইমুল হাসান মিশন শুক্রবার রাতে নিজ বাড়িতে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ব্যাপারটি ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেছেন নাইম হাসানের প্রতিবেশী ও বন্ধু মো. আরমান মজুমদার। নাইমুলের গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার সোনাইপুল গ্রামে। তার বাবা মো. কামাল হোসেন সেনাবাহিনীতে কর্মরর রয়েছেন। মো. আরমান মজুমদার বলেন, নাইমের মা শনিবার ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে উঠলে তার রুমে বাতি জ্বলতে দেখে অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা না খুললে সকাল ৭টায় দরজা ভেঙে তার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। এসময় রুমে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া যায়।
আত্মহত্যার আগে লিখিত চিঠিতে নাইমুল হাসান লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, আমার বেঁচে থাকার জন্য কোনো ইচ্ছা নেই তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি আমার জন্য কেউ কখনো কষ্ট পেয়ে থাকেন, পারলে মাফ করে দিয়েন’। আরমান বলেন, সেনাবাহিনীর অফিসার পদে দুইবার ও মেডিকেলে ভর্তির জন্য দুইবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি মিশন। এজন্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল সে, যেমনটি লিখে গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে রামগড় থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মনির হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এই ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে। লাশ উদ্ধার করেছি। ময়নাতদন্তের পর কারণ জানা যাবে’।
ঋণের চাপে গৃহবধূর আত্মহত্যা: ভোলায় এনজিওর ঋণ ও স্থানীয়দের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে দেনাগ্রস্ত রিংকু বেগম (৩৫) নামের এক গৃহবধূ কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেছেন। নিহত রিংকু বেগম ভোলা সদর উপজেলার পূর্ব পলিশা ইউনিয়নের চর আনন্দ পাট-৩ গ্রামের মো. খোকন মিয়ার স্ত্রী ও ৩ সন্তানের জননী। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে স্বামীর বাড়ি থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রিংকু বেগমের স্বামী পেশায় জেলে। অনেক কষ্ট করে তাদের সংসার চলে। রিংকু বেগম বিভিন্ন এনজিওর থেকে ঋণ ও স্থানীয়দের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে স্বামীর ঘর নির্মাণ করেন। পরে সময় মত কিস্তি পরিশোধ করতে পারতেন না। এছাড়াও স্থানীয়দের কাছ থেকে নেয়া টাকার সুদও ঠিকমত পরিশোধ না করতে পারায় পাওনাদাররা প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছিল। চাপ সহ্য করতে না পেরে শনিবার সকালের কোনো এক সময় কীটনাশক পান করে ঘুমিয়ে পড়ে। পরে বেলা ১১টার দিকে বড় ছেলে তাকে ডাকাডাকি করলে কোনো সাড়া শব্দ মেলেনি। এ সময় তার ডাক-চিৎকারে স্থানীয়রা ছুটে এসে তাকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। ইলিশা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মো. ফরিদ শেখ বলেন, বিকেলে খবর পেয়ে লাশ ময়না তদন্তের জন্য ভোলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়েন নারী ব্যাংকার: বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাততলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যাচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাংকটির একজন নারী মহাব্যবস্থাপক (জিএম)। গুরুতর আহতাবস্থায় ওই নারীকে উদ্ধার করে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের বেসরকারি একটি হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসির আরাফাত কৃষি ব্যাংকের ওই নারী কর্মকর্তার অবস্থা গুরুতর নয়। তিনি কীভাবে পড়েছেন তা জানা যায়নি। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গত বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাততলায় এক নারীর চিৎকার শোনা যায়। একপর্যায়ে দেখেন এক নারী ব্যাংকটির ছয়তলার একটি কার্নিশে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। দ্রুত তাকে নামিয়ে শেরে বাংলা নগরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকটির এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা ওই নারী কর্মকর্তাকে মানসিক অত্যাচার করেছেন। যে কারণে তিনি আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে সাততলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ওই নারী মহাব্যবস্থাপক সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। অনেক দিন ধরে তিনি অসংলগ্ন কথা বলছেন। তাকে ছুটি নিতে বলা হয়েছে।
কিশোরের আত্মহত্যা: রাত জেগে মোবাইল ব্যবহার করতে নিষেধ করায় এক কিশোর ‘অভিমানে আত্মহত্যা’ করেছে বলে জানিয়েছে তার পরিবার। শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার রশিদ বিল্ডিং ২ নম্বর গলির বাসা থেকে পুলিশ ওই লাশ উদ্ধার করেছে বলে ওসি মোহাম্মদ মহসিন জানান। ১৫ বছর বয়সী ওই কিশোরের বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরে। চট্টগ্রামে বোনের বাসায় থেকে একটি চায়ের দোকানে কাজ করত সে। ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ঘরের চালের সাথে রশি দিয়ে সে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে।
সন্তানকে খাবার দিতে না পেরে মায়ের আত্মহত্যাচেষ্টা: গত বছর এপ্রিলে ঢাকার ধামরাইয়ে সংসারের অভাব-অনটনের কারণে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে সন্তানসহ আত্মহত্যাচেষ্টাকারী সেই মা ফের গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করেছেন। উপজেলার কাওয়ালীপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বারবার আত্মহত্যার চেষ্টার কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, পারিবারিক কলহ আর সংসারের অভাব-অনটন। স্বামী সোহেলের চাকরি না থাকায় গৃহবধূ লাইজু আক্তার নীলার দুই শিশুসন্তান, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সংসার চলছে খুবই কষ্টে। তাই প্রতিনিয়ত সংসারে লেগে থাকে ঝগড়া-বিবাদ। স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ায় চা বিক্রেতা শ্বশুর তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে চান। এ নিয়ে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। আর এরই জের ধরে গত ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় ওই গৃহবধূ শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে অবুঝ দুই শিশুসন্তান নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে প্রতিবেশীরা তাদের উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে নিলে তারা প্রাণে বেঁচে যান।

https://dailysangram.com/post/445852