৬ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১১:২৪

এখনও কাজে ফিরতে পারেননি অনেকে

করোনার প্রভাব

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবহন সেবা দিতেন খায়রুল ইসলাম। তিনি আটটি মাইক্রোবাস ও ১৫টি ভ্যানের মালিক। করোনা সংক্রমণের আগে প্রতি মাইক্রোবাসে একজন চালক ও একজন আয়া কাজ করতেন। আর ভ্যান চালাতেন একজন করে। করোনার কারণে গত বছরের মার্চে স্কুল বন্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত এসব শ্রমিক কাজে ফেরার সুযোগ পাননি।

রাজধানীর মতিঝিলে 'হীরাঝিল' রেস্তোরাঁ বেশ পরিচিত। এর ম্যানেজার মো. হানিফ জানিয়েছেন, তাদের হোটেলে দুই শিফটে প্রায় দুইশ কর্মী কাজ করত। সরকার লকডাউনের আদলে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু খোলার পরে সব কর্মীকে কাজ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, হোটেলে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। একই অবস্থা মতিঝিলের আরেক রেস্তোরাঁ 'সরিষা ইলিশ'-এর। এর ম্যানেজার সামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, করোনার আগে তাদের প্রতিষ্ঠানে ২২ জন কর্মী ছিল। বর্তমানে তারা ১৬ জনকে দিয়ে চালাচ্ছেন।

ওপরের দুটি উদাহরণ বলে দিচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থান আগের জায়গায় ফেরেনি। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এ সমস্যা বেশি। পূর্ণ উদ্যমে কাজ করতে না পারা, ব্যয় কমানোর চেষ্টা, প্রযুক্তির ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে কাজের বাজারে স্থরিবতা দূর হচ্ছে না। তবে করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকের তুলনায় এখন পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়েছে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ সময় অফিস-আদালত, কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, বাজারসহ বিভিন্ন খাত বন্ধ ছিল। এতে বেকারত্ব বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারান। সম্প্রতি উৎপাদন ও সেবা খাতের কার্যক্রমে গতি ফিরেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মসংস্থান বিষয়ে কথা বলেছে সমকাল। অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তার পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে করোনার আগে যত লোক কাজ করত, এখন তত মানুষকে কাজে লাগাতে পারছেন না অনেকেই।

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নিয়ে জরিপ করে। এতে দেখা গেছে, ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে কাজের সমস্যায় পড়ে। ৫৬ শতাংশ পরিবার সানেমকে জানিয়েছে, তাদের কাজ থাকলেও পরিবারের প্রধানের আয় কমেছে। ৩৩ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, সাধারণ ছুটির সময় তাদের কাজ বন্ধ ছিল, কিন্তু পরে ফিরে পেয়েছে। ৮ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার প্রধান জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর সময়ের মধ্যে তারা চাকরি হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের কাজ থাকলেও আয় নেই। আর ২ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের অতিরিক্ত সময় কাজ করে চলতে হচ্ছে। আর ৭ শতাংশ পরিবার আগের তুলনায় কম সময় কাজ করছে।

বাংলাদেশ এমপ্লয়মেন্ট ফেডারেশনের সভাপতি কামরান টি রহমান সমকালকে বলেন, কলকারখানা খুললেও পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি অনেকেই। দেশের কলকারখানা অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের প্রতিষ্ঠানের বিদেশনির্ভরতা বেশি। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনও চাহিদা আগের জায়গায় যায়নি। অন্যদিকে দেশে সবকিছু শুরু হলেও চাহিদা কমে গেছে। চাহিদা না বাড়লে কর্মসংস্থান আগের জায়গায় ফিরবে না।

কোন খাতে কী অবস্থা :কর্মসংস্থান করোনার আগের জায়গায় ফেরেনি- এমন খাতের মধ্যে পরিবহন অন্যতম। সাধারণ ছুটির সময় গণপরিবহন বন্ধ করায় পরিবহন শ্রমিকদের পাশাপাশি পেট্রোল পাম্প ও মেরামত কারখানার কর্মীদের অনেকেই বেকার হয়ে পড়েন। এখন গণপরিবহন চালু হলেও সবার কাজের সুযোগ হয়নি। অনেক বাস কোম্পানি কাউন্টারে লোক কমিয়ে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করেছে। অনেক পেট্রোল পাম্পও সব কর্মীকে কাজে নেয়নি।

একই অবস্থা শপিংমল ও দোকানপাটের কর্মীদের। এখন সবই খুলেছে। কিন্তু অনেক দোকান মালিক পুরোনো সব কর্মী কাজে ফেরাননি। রাজধানীর মৌচাকের আনারকলি মার্কেটের স্মার্ট গার্ল নামের একটি দোকানে করোনার আগে ছয়জন কর্মী ছিল। এখন চলছে চারজন নিয়ে। এর মালিক শহিদুল ইসলাম বলেন, বেচাকেনা আগের অবস্থায় এখনও ফেরেনি। কবে ফিরবে বা আদৌ ফিরবে কিনা বলা যাচ্ছে না। ফলে খরচ কমানো ছাড়া উপায় নেই।

শিক্ষা সরঞ্জাম ( জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বাইরের বইপত্র, খাতা, কলম, পেন্সিল, ব্যাগসহ অন্যান্য) নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করে সেখানে কাজের সুযোগ কমেছে। অরুপ নাগ বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কাগজ সরবরাহ করেন। গত এক বছরে তার ব্যবসা ৮০ ভাগ কমেছে। তার প্রতিষ্ঠানের চারজন কর্মীর তিনজনকে এখনও পর্যন্ত ছুটিতে রেখেছেন। এদিকে, কোচিং সেন্টার এখনও বন্ধ। বাসাবাড়িতে গিয়ে যারা টিউশনি করতেন, তারাও সবাই পড়ানো শুরু করতে পারেননি। ফলে টিউটর ও কোচিং সেন্টারের সঙ্গে সম্পৃক্তরা কাজে ফিরতে পারেননি।

রাজধানীসহ দেশের সব জায়গায় হকারের সংখ্যা কমেছে। পান, সিগারেট, চা, ডাব, বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের হকাররা আগের মতো আয় করতে পারছেন না। মানুষ সাবধানতার অংশ হিসেবে বাইরে কম খাচ্ছেন। আমদানি-রপ্তানি তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়ায় বন্দরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যারা দৈনিকভিত্তিতে করত তাদের চাহিদা কমেছে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অফিসেও আগের তুলনায় কম লোক কাজ করছে। সরকার উন্নয়ন ব্যয় কমানোর ফলে সারাদেশে নির্মাণ খাতসহ অন্যান্য খাতের দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমেছে।

অভ্যন্তরীণ পর্যটন মোটামুটি চাঙ্গা হলেও আন্তর্জাতিক পর্যটন এখনও ঝিমিয়ে রয়েছে। দেশের তারকা হোটেলগুলো এখনও অতিথি পাচ্ছে না। রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলের ব্যবস্থাপক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ওয়েটার, ক্লিনার, বারটেন্ডারের মতো কাজে তাদের অনেক কর্মীকেই ফেরানো সম্ভব হয়নি। আবার এসব হোটেলে যারা দৈনিকভিত্তিতে কাজ করত তাদের চাহিদাও কমেছে। একটি ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের ট্যুর কোচগুলো এখনও বসে আছে। ফলে সব কর্মী কাজে ফিরতে পারেনি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে আনুষ্ঠানিক খাতে ১৩ শতাংশ লোক চাকরি হারান। বেতন কমে যায় ২৫ শতাংশ মানুষের। এ সময়ে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েন। বিআইডিএস গত বছরের ৫ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ২৯ হাজার ৯০৯ জনের ওপর অনলাইনে এ জরিপ করে।

বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ সমকালকে বলেন, রপ্তানিনির্ভর খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পুরো উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের সব কর্মী কাজে ফেরার সুযোগ পাননি। করোনার সময়ে নতুন ধরনের কিছু কর্মসংস্থান হলেও যেসব পুরোনো কর্মী চাকরি হারান, তাদের কাজে ফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানে কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান যতটুকু উৎপাদন করতে হচ্ছে, তার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল রেখে বাকিদের ছাঁটাই করছে। অন্যদিকে প্রযুক্তি কার্যক্রমে নতুনদের কাজের সুযোগ হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে করোনার সময়ে কর্মসংস্থান যেভাবে কমে গিয়েছিল, সে অবস্থা এখন না থাকলেও সবাই কাজে ফিরতে পারেননি।

কিছু ব্যতিক্রম :ডিটারজেন্ট, সাবান, ওষুধ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবসায় নতুন করে অনেকে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। ইন্টারনেট সংযোগ বেড়েছে। বেড়েছে এ খাতে কর্মীর সংখ্যা। ইলেকট্রনিক পণ্য বেচাকেনা ও মেরামত কার্যক্রম আগের চেয়ে গতিশীল হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি খাতে নিয়োগ বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি সব খাতেই কম-বেশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বেসরকারি খাতের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা সরবরাহ ও ই-কমার্স খাতে নতুন কর্মী নিয়োগ করেছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/210354850