৬ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১০:৫১

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ব্যবসায়ীদের

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : এমনিতেই ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড করেছে। বিক্রি মূল্য ইতোমধ্যে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। সরকারের বেধে দেয়া নির্ধারিত দামে রাজধানীর কোথাও ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রেতারা নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে না পারার কারণ হিসাবে পাইকারিতে না কমার অভিযোগ করছেন। এদিকে ব্যবসায়ীরা পবিত্র রমযানকে সামনে রেখে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। রীতিমতো তেল নিয়ে তেলেসমাতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে সয়াবিন ও পামওয়েলের দাম লিটারে আরও ৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় মূল্য পর্যবেক্ষণ ও নির্ধারণ কমিটি।

জানা গেছে, সরকার গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। বোতলের প্রতি লিটার সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১২৭ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আর বোতলের ৫ লিটার সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৮৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৬০০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ৬৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেইসঙ্গে পাম সুপারের প্রতি লিটার মিলগেট মূল্য (খোলা) ৯৫ টাকা, পরিবেশক মূল্য ৯৮ এবং খুচরা বাজারে ১০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এখনও ভোজ্যতেলের দরের ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অরাজকতা দেখা গেছে। অধিকাংশ বাজার বা দোকানেই সরকার নির্ধারিত দরে ভোজ্যতেল বা সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে খোলা সয়াবিন তেল ১১৫ টাকা দরে বিক্রি করার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়। একইভাবে পামসুপার বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকায়। যা বিক্রি করার কথা প্রতিলিটার ১০৪ টাকা। বোতলের ৫ লিটার সয়াবিন তেল ৬৩০ টাকায় বিক্রি করার কথা থাকলেও তা বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ টাকার ওপরে। ১৩৫ টাকা বোতলে এক লিটার সয়াবিন পাওয়া গেলেও কোনও কোনও কোম্পানির বোতলের এক লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৩৮ টাকায়। এ বিষয়ে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আমরা পাইকারি বাজারে সরকার নির্ধারিত দরেই ভোজ্যতেল বিক্রি করছি। পাইকারি বাজারে এখন সুপারপাম তেল ৯৬ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেল ১১০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু বাজারে গিয়ে তার আলামত পাওয়া যাচ্ছে না।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন-সংক্রান্ত সরকারি ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কমিটি ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে। নির্ধারিত মূল্যে ভোজ্যতেল বিক্রি নিশ্চিত করা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় কমিটি ভোজ্যতেলের মধ্যে প্রতি লিটার সয়াবিন (খোলা) মিলগেটে ১০৭ টাকা, পরিবেশক মূল্য ১১০ টাকা এবং খুচরা মূল্য ১১৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ১২৩, পরিবেশক মূল্য ১২৭ এবং খুচরা বিক্রয়মূল্য ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন মিলগেট মূল্য ৫৯০, পরিবেশক মূল্য ৬১০ এবং খুচরা বিক্রয় মূল্য ৬৩০ টাকা। প্রতি লিটার পাম সুপার (খোলা) তেলের মিলগেট মূল্য ৯৫, পরিবেশক মূল্য ৯৮ এবং খুচরা বিক্রয়মূল্য ১০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আসন্ন পবিত্র রমযান মাসকে সামনে রেখে পর্যাপ্ত মজুদ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে কোনো অবস্থাতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট না হয়। এ জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিয়মিত সভা করে ভোজ্যতেলের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করা হবে।

তবে গত বুধবার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সভাকক্ষে কমিটি ও ব্যবসায়ীরা একটি মিটিং করে। মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোজ্যতেরে মূল্য বৃদ্ধি প্রস্তাবনাটি নিয়ে আলোচনা হলেও জাতীয় মূল্য পর্যবেক্ষণ ও নির্ধারণ কমিটি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। আন্তর্জাতিক বাজার ও মূল্য নির্ধারণে আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণ করে তবেই কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স ও অপারেশন) মো. শফিউল আতহার তাসলিম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে আমরা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। একইসঙ্গে বোতলের দাম পুনঃনির্ধারণেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কমিটি সেটা পর্যবেক্ষণ করছে।

বর্তমান দামের সঙ্গে লিটারে আরও ৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাবনা দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১১৯০ ডলারে। এর আগে যখন দাম নির্ধারণ করা হয়, প্রতি টনের দাম ছিল ১০৯০ ডলার। জানা গেছে, করোনাকালে চীন নিজেদের চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত তেল কিনে রিজার্ভ করেছে। যে কারণে গত ছয় মাসের বেশি সময় ধরেই আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসেই আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে আরও চড়া দামে তেল বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। মেঘনা গ্রুপের এজিএম মো. তাসলিম শাহরিয়ার (অ্যাকাউন্টস) বলেন, ‘ভারতে ৭০ শতাংশ তেল নিজেদের উৎপাদিত এবং ৩০ শতাংশ আমদানি করে পরিশোধন করা হয়। তারপরও ভারতে তেলের দাম বেশি। বাংলাদেশে শতভাগ আমদানি হলেও সে তুলনায় দাম বেশি বাড়েনি। মিটিংয়ে ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বোতলের দাম বাড়ানো এবং ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের মার্জিন বাড়ানোর প্রস্তাবনাও দিয়েছে। বর্তমানে ১ লিটারের বোতলের দাম ১৫ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতলের দাম ৫০ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে শুধু সয়াবিন তেল ও পাম ওয়েলের মোট চাহিদা রয়েছে ১৮-২০ লাখ টন। রমযান মাসের চাহিদা রয়েছে ২.৫-৩ লাখ টন।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাবে যেন দেশে তেলের সরবরাহ কমে না যায়, সে ব্যাপারেও ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে সব ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ীকে প্রয়োজনীয় তেল আমদানির নির্দেশনা দিয়েছে। কারণ এপ্রিলের মাঝামাঝিতে রোজা শুরু হবে। সে সময় যেন সরবরাহে কোনো সংকট তৈরি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখছে সরকার। গত জানুয়ারি মাসে প্রায় দেড় লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামওয়েল এবং ফেব্রুয়ারিতে ২ লাখ টনের বেশি তেল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। আমদানি করা কিছু তেল স্টকেও রয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি তেল সরবরাহে কোনো সংকট হবে না।

তবে বেশ কিছুদিন ধরেই অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার। দফায় দফায় বাড়ছে দাম। সম্প্রতি সময়ে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে আসে। উল্লেখ্য, দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য বছরে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা হচ্ছে ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে সয়াবিনের চাহিদা ১১ লাখ টন, পামঅয়েলের চাহিদা ৩ লাখ টন এবং সরিষা তেলের চাহিদা ১ লাখ টন।

https://dailysangram.com/post/445760