৬ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১০:৫০

রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও গায়েবি মামলায় উদ্বেগ বাড়ছে

নাছির উদ্দিন শোয়েব : দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়া এবং গায়েবি মামলায় উদ্বেগ বাড়ছে। সম্প্রতি কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হওয়া পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় প্রার্থীসহ অন্তত পাঁচজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও বিরোধী দল বিএনপির কয়েকটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এছাড়াও মামলাগুলোতে আরো কয়েকশ ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামী হিসাবে উল্লেখ করা হয়। মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী রাজনৈতিক সংঘাতে সাত বছরে ৬৪০ জন নিহত হয়েছেন।

জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিজয়ী ঘোষণার পরেই প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছেন মো. তরিকুল ইসলাম খান। গত ১৫ জানুয়ারি রাতে পৌর শহরের শহীদগঞ্জ এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত তরিকুল ইসলাম শহরের নতুন ভাঙাবাড়ি এলাকার আবদুল কুদ্দুসের ছেলে। পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ডালিম প্রতীকে তিনি ৮৫ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। চতুর্থ ধাপের পৌরসভা নির্বাচনের পর ১৫ ফেব্রƒযারি অন্তত ১১টি পৌরসভায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক কাউন্সিলর প্রার্থীর ভাই খুন হয়। ভোট দিতে গিয়ে গোলাগুলির এক পর্যায়ে ৭০ বছর বয়স্ক একজন নারীও গুলিবিদ্ধ হন। নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভা নির্বাচন চলাকালে নির্বাচনী সহিংসতায় ছোটন (৪০) নামে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থক নিহত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভোট চলাকালে সৈয়দপুর মহিলা কলেজ কেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থী ও সমর্থকদের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম রয়েলের সমর্থক ছোটন গুরুতর আহত হন। এ মারামারির ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম রয়েল ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আযম আলী গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ ও বিজিবি পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

১৭ জানুয়ারি পৌরসভা নির্বাচনের রেশ ধরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুল হোসেন সবুজকে কুপিয়েছেন উপজেলা যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কামরুল বক্স। দুপুর ১২টার দিকে কুলাউড়া উছলাপাড়া এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মঈনুল হোসেনের ছোট ভাই ইকবাল হোসেন কয়েছ জানান, দুপুরের দিকে সবুজ কুলাউড়া উছলাপাড়া এলাকার আমিনুল ট্রেডার্সে বসা ছিলেন। হঠাৎ করে উপজেলা যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কামরুল বক্স ১৫-২০ লোক নিয়ে দেশীয় অস্ত্রসহ তার উপর আক্রমণ করে। এসময় তাদের অস্ত্রের কুপে তার হাত, মাথা, পেট ও পীঠে মারাত্বকভাবে জখম হয়। স্থানীয়রা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে কুলাউড়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে তার অবস্থা গুরুত্বর হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে প্রেরণ করেন। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জার অনুসারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্থানীয় সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির নিহত হন। ২৫ বছর বয়সী মুজাক্কির দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এ সময় মুজাক্কিরসহ সাতজন গুলিবিদ্ধ হন, আহত হন আরও অন্তত ২৫ জন। তিনি উপজেলার চরফকিরা ইউনিয়নের নোয়াব আলী মাস্টারের ছেলে। সংঘর্ষের ঘটনায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল বাদী হয়ে একটি এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই সফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেন। সেখানে চরফকিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন লিটনকে প্রধান আসামী করে আরও ৪৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৫০০-৬০০ জনকে আসামী করা হয়। একই ঘটনায় আবদুল কাদের মির্জার পক্ষেও থানায় একটি অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একই সময় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই সফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে আরও একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায়ও অজ্ঞাত পরিচয় ৫০০-৬০০ জনকে আসামী করা হয়েছে।

এদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি এবং কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ৪৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ওই সংঘর্ষের ঘটনার পর রাতে শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করা হয় বলে ওসি মামুন-অর-রশীদ জানান। তিনি বলেন, আসামীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধর, সরকারি কাজে বাধা, ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে ৪৭ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আজ্ঞাতনামা আরও ২০০ থেকে ২৫০ জনের কথা উল্লেখ হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন গ্রেপ্তার আছে। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড পাওয়া ১৩ জন আসামী হলেন আহসান হাবিব ভূঁইয়া, কবির হোসেন, মঞ্জুরুল আলম, মনোয়ার ইসলাম, আরিফুল হক, আনিসুর রহমান, আতাউর রহমান, মাসুদ রানা, আতিফ মোরশেদ, রমজান আহমেদ, শফিকুল ইসলাম, মো. শাহিরাজ ও আবু হায়াত জুলফিকার। এরআগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপির সমাবেশের আগে পুলিশের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার ২৯ নেতা-কর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২৯ জনকে ২ দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। এই ২৯ জনের মধ্যে ১৩ জনকে রমনা থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ ছাড়া বাকি ১৬ জনকে শাহবাগ থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ছয় বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ৬৩৫ জন নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তারের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে এসব ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আধিপত্য বিস্তারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাতে জড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচন, ক্ষমতা বিস্তারকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এমনকি নিজ দলের ভেতরেও অন্তর্কোন্দল রূপ নেয় সংঘর্ষে। যার কারণে ঘটে প্রাণহানী। আসকের হিসাবে গত ৬ বছরে দেশে মোট তিন হাজার ৭১০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। তাতে নিহত হয়েছেন ৬৩৫জন, আহত ৪১ হাজার ৩৪৫ জন।

আসক-এর হিসাবে, শুধু ২০১৯ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩৯ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন দুই হাজার ৬৮৯ জন। সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে মোট ২০৯টি। ২০১৮ সালে এমন ঘটনার সংখ্যা ছিল ৭০১টি। এতে ৬৭ জন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছেন সাত হাজার ২৮৭ জন। ২০১৭ সালে নিহত হয়েছেন ৫২ জন আর আহত চার হাজার ৮১৬ জন। সেবছর রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ৩৬৪টি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানী হয়েছে ২০১৬ সালে। মোট ১৭৭ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১১ হাজার ৪৬২ জন। সংঘাতের ঘটনা ছিল ৯০৭ টি। ২০১৫ সালে ১৫৩ জন আর ২০১৪ সালে ১৪৭ জন মারা গেছে এমন সহিংসতার কারণে। এইসব ঘটনা প্রধানত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এর বাইরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচন, নির্বাচন প্রতিরোধ এবং মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা ছিল সহিংসতার প্রধান কারণ।

https://dailysangram.com/post/445758