৬ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১০:৪৯

নাগরিক অধিকার কোন পথে?

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেক দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে। অনেক দেশে পরিপূর্ণ বেসামরিক সরকার থাকলেও সেখানে গণতন্ত্র কতটা কার্যকরী আছে সেটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একটি দেশে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও সে দেশে গণতন্ত্র নাও থাকতে পারে।

বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো বলে আসছে দেশে এখন আর কোন গণতন্ত্র অবশিষ্ট নাই। দাবি আদায় করতে তারা রাস্তায় পর্যন্ত নামতে পারছেন না। রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কথা বললেই হামলা-মামলা খুন গুমের শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধীদলগুলোর। একই অবস্থা অন্যান্য পেশাজীবীদের বেলাতেও। ঝুকিপূর্ণ মনে হলেই চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা একদমই কম বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে আর্ন্তজাতিক গবেষণা রিপোর্ট থেকে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউজ নামের সংস্থার ২০২১ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ‘'আংশিক স্বাধীন'’ দেশগুলোর মধ্যে তলানিতে বাংলাদেশের অবস্থান। এ বছর বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ৩৯ (১০০ এর মধ্যে)। এর মধ্যে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অধিকারে ৪০-এ ১৫ এবং নাগরিক স্বাধীনতায় ৬০ এর মধ্যে ২৪ পেয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হচ্ছে।

২০২০ সালে একই অবস্থানে থাকলেও ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪১, ও তার আগের বছর ২০১৮ সালে ছিল ৪৫ এবং ২০১৭ সালে ছিল ৪৭। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এটিকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয়েছে। "রিপোর্টটি অ্যাবসুলেটলি বায়াসড ও আনসাবস্টেনশিয়েটড (পুরোপুরি পক্ষপাতমূলক ও ভিত্তিহীন)," বিবিসিকে বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। যেসব দেশ ও অঞ্চলের স্কোর গড়ে ১ থেকে ৩৪ এর মধ্যে, তাদের ‘স্বাধীন নয় (হড়ঃ ভৎবব)', ৩৫ থেকে ৭১ হলে তাদের ‘আংশিক স্বাধীন (ঢ়ধৎঃষু ভৎবব)’ এবং ৭২ এর বেশি হলে তাদেরকে ‘স্বাধীন (ভৎবব)’ হিসেবে রিপোর্টে বলা হচ্ছে।

যেমন তিব্বত অঞ্চল, সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদান ১ স্কোর নিয়ে, ইরিত্রিয়া ২ স্কোর নিয়ে, উত্তর কোরিয়া ৩ স্কোর, সোমালিয়া ও সৌদি আরব ৭ স্কোর নিয়ে ‘স্বাধীন নয়’ দেশের তালিকায় নিচের দিকে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ২৭ স্কোর নিয়ে আফগানিস্তান, ২৭ ও ২৮ স্কোর নিয়ে যথাক্রমে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চল ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চল ‘স্বাধীন নয়’ তালিকায়। আর ৩৭ স্কোর নিয়ে পাকিস্তান ‘আংশিক স্বাধীন’ দেশের তালিকায় তলানিতে স্থান পেয়েছে। এরপরেই বাংলাদেশের অবস্থান (স্কোর ৩৯)।

তবে সবচেয়ে ‘স্বাধীন’ দেশ হিসাবে তালিকায় রয়েছে সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড (স্কোর ১০০)। এরপরে ৯৯ স্কোর নিয়ে আছে নিউজিল্যান্ড, ৯৮ স্কোর নিয়ে আছে কানাডা, উরুগুয়ে ও নেদারল্যান্ড। এছাড়া ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির স্কোর ৯৪, যুক্তরাজ্যের স্কোর ৯৩, ফ্রান্সের স্কোর ৯০, যুক্তরাষ্ট্রের স্কোর ৮৩, ভারতের স্কোর ৬৭, তুরস্কের স্কোর ৩২, রাশিয়ার স্কোর ৩২, ইরানের স্কোর ১৬, এবং চীনের স্কোর ৯।

সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদনে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে - রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা। রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক প্লুরালিজম বা বহুত্ববাদ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ, সরকারের কার্যকারিতা, নীতি-নির্ধারণী ব্যবস্থা, ক্ষমতার ব্যবহার ও স্বচ্ছতা সম্পর্কিত নানা বিষয়।

অন্যদিকে নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিশ্বাস, মানবাধিকার সংস্থাসহ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা, আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা, ব্যক্তি স্বাধীনতা। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে এমন মূল্যায়ন করা হয়েছে।

কোনো দেশে গণতন্ত্র আছে কি-না তা নিয়ে কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নির্বাচন হলো ‘গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা’ । সে নির্বাচন হতে হবে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ। যে দেশে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং জবরদখল হয় সেটিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলতে নারাজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।

যেসব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র আছে সেখানেও নিয়মিত নির্বাচন হয়। কারণ তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এখন নির্বাচনে কারচুপি শুধু জাল ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়না, এর নানা দিক আছে। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের গবেষক ব্রায়ান ক্লাস বলেন, নির্বাচনের সময় অধিকাংশ একনায়ক শাসক তাদের প্রতিন্দ্বন্দ্বিকে নানা কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য করে দেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানিরা বলছেন, গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের প্রাধান্য একটি বড় বিষয়। একটি সরকার নির্বাচিত হলেই গণতান্ত্রিক হয়না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে গণতন্ত্র না থাকলে এবং একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হলে জনগণের মতামতকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়। এর ফলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতার মনে করেন, ‘সিভিলিয়ান অটোক্র্যাট’ বা ‘বেসামরিক স্বৈরশাসক’ বলে একটি কথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু আছে। তিনি বলেন, "অনেক সময় গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্র দেখে অনেক সামরিক শাসকও লজ্জা পেতে পারে। ২০১২ সালে নির্মিত কমেডি চলচ্চিত্র ‘দ্য ডিক্টেটর''। এই চলচ্চিত্রে কাল্পনিক দেশ ওয়াদিয়ার স্বৈরশাসকের চরিত্রে অভিনয় করেন সাচা ব্যারন কোহেন। একটি দেশে একজন স্বৈরশাসকের পক্ষে কী কী নৈরাজ্য চালানো সম্ভব তা ঠাট্টা এবং তামাশাচ্ছলে চলচ্চিত্রটিতে তুলে আনেন পরিচালক।

যে দেশে গণতন্ত্র থাকেনা সেখানে শাসকগোষ্ঠী নিয়মিত নানা ধরণের নির্বাচন অনুষ্ঠান করলেও সেসব নির্বাচনের প্রতি মানুষের কোন আস্থা থাকেনা। ভোটাররা ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তারা ভোট দেবার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে চায়না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, একটি দেশে যখন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হবার দিকে ধাবিত হয় তখন সংসদে ক্ষমতাসীনদের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে। সংসদে কার্যত কোন বিরোধী দল থাকে না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, গণতন্ত্র না থাকলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নানা ধরনের আইন-বহির্ভূত কাজে জড়িয়ে পড়ে। কারণ, শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিরাপত্তাবাহিনীকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং সাধারণ মানুষকে দাবিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করে।

অধ্যাপক ইয়াহিয়া আখতারের মতে, গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে কিছু প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরী করতে হয়। যেমন: নির্বাচন কমিশন, সংসদ, বিচার বিভাগ ইত্যাদি। অধ্যাপক আখতার বলেন, একটি দেশে যদি এসব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে এবং সেগুলো ভঙ্গুর অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে বুঝতে হবে সে দেশে গণতন্ত্র নেই।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমও স্বাধীনভাবে কাজ করতে ভয় পায়। এমনকি শাসকগোষ্ঠী ইন্টারনেটও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যাতে করে মানুষ সেখানে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে না পারে।

একনায়কতন্ত্রে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ক্রয় করার জন্য এই দুর্নীতি ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থায় দুর্নীতি এমন সুন্দরভাবে সাজানো হয় যে, সেটি অল্প কিছু ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। শাসকের অনুগত হবার বিনিময়ে তাদের দুর্নীতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়। ফলে তারা আরো ধনী হয়। যদি কোন কারণে সন্দেহ হয় যে তারা শাসকের অনুগত নয়,তখন তাদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

একনায়ক শাসকরা অবসরের ভয়ে থাকেন। তাদের মনে থাকে যে ক্ষমতা হারানোর পর একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হবে। ফলে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিশোধ নিতে পারে।

https://dailysangram.com/post/445757