৬ মার্চ ২০২১, শনিবার, ১০:৪৬

করোনা কি চিরদিনের জন্য বিদায় নেবে?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : একসময় বসন্ত, হাম, প্লেগ ইত্যাদি রোগে অনেক মানুষ মরতো। যে এলাকায় এসব রোগ হতো সে এলাকা দিয়ে মানুষ যাতায়াত বন্ধ করে দিতেন। ছোটবেলা দেখেছি, আমাদের গ্রামে একবার বসন্ত রোগ হলো। প্রায় সববাড়িতেই দুয়েকজন করে মানুষ মরলো। শুধু আমাদের বাড়িতে রোগটি হলো না। আল্লাহর কী রহম, আমরা সেবার বেঁচে গেলাম।

করোনাপ্রতিরোধে ভ্যাকসিন কেন নিতে হবে বিজ্ঞানীরা বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেননি এখনও। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, টিকার বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। পরীক্ষানিরীক্ষা বা গবেষণার মধ্যেই রয়েছে। তাই টিকাগ্রহণের পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ মাস্ক পরতে হবে। নিয়মিত ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত ধুতে অথবা স্যানিটাইজার ইউজ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করতে হবে চলাচলও।

তবে আমাদের দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবার বিষয়টি মোটেও গুরুত্ব পায়নি। টিকা কার্যক্রম শুরুর পর মাস্কপরাসহ সাবান দিয়ে হাতধোয়া এবং দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত হয়ে পড়েছে। গ্রামে দূরে থাক, শহরেও অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ছেড়ে দিয়েছেন। হাতধোয়া ও শারীরিক দূরত্বও আর মানছেন না শহরের বেশিরভাগ মানুষ।

মহামারি করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে টিকাগ্রহণ জরুরি। এর বিরোধিতা আমরাও করছি না। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাই হোক, টিকা কতটা কার্যকর হচ্ছে বা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এন্তার।

করোনা ভ্যাকসিন দেবার মূল উদ্দেশ্য হলো: নিরাপদ উপায়ে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন। মার্কিন ডাক্তার ফাউসির মতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটির জন্য জনসংখ্যার ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ লোককে ভ্যাকসিন দিতে হবে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার ১৮ বছরের নিচের লোকদের ভ্যাকসিন দেয়াই হবে না। অথচ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৮ বছরের নিচের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। এ বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি ভ্যাকসিন থেকে বাদই থাকে, তাহলে বাকি ৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন দিয়ে কীভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে? হার্ড ইমিউনিটির জন্য ভ্যাকসিন দেবার প্রয়োজন তো ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ লোককে?

বাংলাদেশের প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমছে। এ দৃশ্য নির্দেশ করে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক উপায়ে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক উপায়ে যদি হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়, তবে ভ্যাকসিন দিয়ে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির দরকার আছে কি?

সারাবিশ্বে পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাস বেশি ক্ষতি করেছে এক বা একাধিক ক্রোনিক ও জটিল রোগে আক্রান্তদের। অথচ এ ধরনের লোকদের ভ্যাকসিন না দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন দেবার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যারা মারা গেছেন, তাঁরা এ শ্রেণির লোক। করোনাভাইরাস পজিটিভ হবার পর যেশ্রেণির লোকদের সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশি বা গন্ধহ্রাসে করোনা সেরে গেছে, তাদের ভ্যাকসিন দেবার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব তো ছিল যেশ্রেণির লোকেরা করোনায় মারা যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য করোনা ভ্যাকসিন কার্যকরী হলে। কিন্তু আসল ভুক্তভোগীদেরই তো ভ্যাকসিন দেয়া নিষিদ্ধ।

বলা হচ্ছে, “যাদের করোনা হয়েছে, তারাও ভ্যাকসিন নেবে।” কিন্তু যাদের করোনা হয়েছে, তাদের শরীরে তো প্রাকৃতিক উপায়ে এন্টিবডি তৈরি হবার কথা। উত্তরে দাবি করা হচ্ছে: “প্রাকৃতিক উপায়ে যে-এন্টিবডি হচ্ছে, তা দীর্ঘস্থায়ী না।” প্রাকৃতিক উপায়ে এন্টিবডি তৈরি যদি না হয়, তবে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তৈরি এন্টিবডি যে দীর্ঘস্থায়ী হবেই তার গ্যারান্টি কে দেবেন? সেই এন্টিবডি কতদিন থাকবে, তাও সঠিক জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
বলা হচ্ছে, “ভ্যাকসিন দেবার পরও করোনা হতে পারে।”
ভ্যাকসিন দেবার পরও যদি করোনা হয়, তবে সেই ভ্যাকসিন দিয়ে লাভ কী?
বলা হচ্ছে, “আপনি ভ্যাকসিন নিলে আপনার বাসার প্রবীণরা নিরাপদ থাকবে।”
ভ্যাকসিন নেবার পর যদি আমার শরীরে করোনা ঢুকতে পারে, তবে বাসার প্রবীণরা কীভাবে নিরাপদ থাকবেন?

ফ্লুর মতো ভাইরাসের এখন পর্যন্ত কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। কারণ সেগুলো দ্রুত ধরন পরিবর্তন করে। তাই প্রতিবছর ফ্লু সিজনের আগে ইউরোপ-আমেরিকার লোকরা ফ্লু-শট নেবার পরও তাদের ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়া বা মৃত্যু কখনও কমতে দেখা যায় না। অন্য ফ্লু ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হলে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে এটা আমরা কীভাবে নিশ্চিত হবো?

ভ্যাকসিন দিলে কতদিন শরীরে এন্টিবডি কার্যকর থাকবে, তার নিশ্চয়তা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো দিতে পারছে না। হয়তো দেখা যাবে, তারা ৬ মাস বা ১ বছর পর ফ্লু সিজন এলে আবার ভ্যাকসিন নিতে বলবে। অর্থাৎ এ ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে আমরা কি ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলোর পার্মানেন্ট কাস্টমার বা বছর বছর ফ্লু-শটের গ্রাহক হতে যাচ্ছি?

ওষুধ কোম্পানিগুলো মাঝে মাঝে আফ্রিকার দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর তাদের ওষুধের ট্রায়াল চালায়। এ কারণে আফ্রিকার দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোতে বিভিন্ন ভয়ানক রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এগুলো সেই ওষুধগুলোর ইফেক্ট-সাইড বা ইফেক্ট দুটোই হতে পারে। ধরা যাক, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেবার পর তাৎক্ষণিক কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বড় কোনও সমস্যা বা রোগ দেখা দিল। তার দায়ভার কে নেবে?

আসলে ভ্যাকসিন কেন দেয়া হবে, জনগণের স্বার্থে? নাকি ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলোর স্বার্থে? তা পরিষ্কার নয় এখনও। যদি জনগণের স্বার্থে হতো, তবে অবশ্যই ওপরের বক্তব্যগুলোর সদুত্তর পাওয়া যেতো। যেহেতু ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলো এতদিন করোনার পেছনে যথেষ্ট ইনভেস্ট করে ফেলেছে, তাই তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই এখন আমাদের কষ্ট করে ভ্যাকসিন নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া করোনা ভ্যাকসিন নেবার পক্ষে যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল বৈকি।

এতোদিন দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেবার কথা হয়েছে। এখনও তাই চলছে। প্রথম ডোজ নেবার দুই মাসপর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। এখন এক ডোজের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তা অনুমোদনও করেছে। এক ডোজে কাজ হয়ে গেলে দুই ডোজ মানুষ নেবে কেন?

যাই হোক, কোনও কোনও দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের দাপট কিছুটা কমলেও অনেক দেশে আবারও বাড়ছে। কোথাও কোথাও সংক্রমণ ঠেকাতে দিতে হচ্ছে লকডাউন। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে বহু দেশে। ইতোমধ্যে বিশ্বে করোনায় মারা গেছেন প্রায় ২৬ লাখ আদমসন্তান। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১২ কোটি। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে দাপুটে ভাইরাসটির প্রকোপ কমলেও একেবারে চলে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো পৃথিবীর মানুষকে ভোগাবে আরও বহুদিন! বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে, করোনাভাইরাস এবছরও যাচ্ছে না।

বিশ্বের সবদেশ করোনার ভ্যাকসিন এখনও পায়নি। বাংলাদেশিরা ভাগ্যবান। ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে। আরও পাওয়া যাবে। সরকারি তথ্যমতে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩৩ লাখের বেশি নাগরিককে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চলছে। ভিন্নমত সত্ত্বেও এর সুফল সবাই লাভ করুন এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

https://dailysangram.com/post/445747