৫ মার্চ ২০২১, শুক্রবার, ১০:৪২

চক্রাকার বাস হঠাৎ উধাও

বিআরটিসি বলছে ভর্তুকি দিলে তারা এই সার্ভিস অব্যাহত রাখতে পারবে

বেশ আয়োজন করেই ঢাকা দক্ষিণ সিটির আজিমপুর-মোহাম্মদপুর, মোহাম্মদপুর-কমলাপুর রুটে এবং ঢাকা উত্তরের উত্তরার দুটি রুটে চালু করা হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) এসি বাস। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলছিল বিআরটিসির এই চক্রাকার সার্ভিসটি। কিন্তু হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে এই সার্ভিস। আজিমপুর-মোহাম্মদপুর কিংবা নির্ধারিত অন্যান্য রুটেও দেখা মিলছে না বিআরটিসির চক্রাকার বাসের।

বিআরটিসির চক্রাকার বাস সড়কে না থাকার পেছনে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। একপক্ষ বলছে, লোকসান পুষিয়ে উঠতে পারছে না বিআরটিসি। যদি সিটি করপোরেশন ভর্তুকি দেয় তাহলে সার্ভিসটি ফের চালু হবে, নয়তো এই সার্ভিস আর চলবে না। আরেক পক্ষ বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর ২৬ মার্চের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর বিআরটিসির চক্রাকার সার্ভিসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর সব ধরনের যানবাহন রাস্তায় নামলেও বিআরটিসির চক্রাকার বাস আর রাস্তায় দেখা যায়নি। কবে আবার চালু হবে তা-ও বলা যাচ্ছে না। হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর যাত্রীর সংখ্যা বাড়লে চক্রাকার বাস সার্ভিসও চালু করা হবে।

রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ আজিমপুর-নিউ মার্কেট-ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর রুটে চালু করা হয় বিআরটিসির চক্রাকার বাস সার্ভিস। চক্রাকার বাসগুলো আজিমপুর-নিউ মার্কেট-সায়েন্স ল্যাব-ধানমণ্ডি ২ নম্বর রোড, সাত মসজিদ রোড (জিগাতলা, শংকর), ধানমণ্ডি ২৭, মোহাম্মদপুর, সোবহানবাগ, রাসেল স্কয়ার, কলাবাগান, সায়েন্স ল্যাব, বাটা ক্রসিং, কাঁটাবন, নীলক্ষেত, পলাশী হয়ে আবার আজিমপুর আসত। বিপরীত দিক থেকে আজিমপুর, নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, কলাবাগান, সোবহানবাগ, ২৭ নম্বর রোড পূর্ব মাথা থেকে পশ্চিম মাথা, সাত মসজিদ রোড, বিজিবি ২ নম্বর গেট, ৩ নম্বর রোডে ইউ টার্ন নিয়ে ফের সায়েন্স ল্যাব-বাটা ক্রসিং-কাঁটাবন, নীলক্ষেত, পলাশী হয়ে আজিমপুর যেত। সর্বনিম্ন ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা ছিল।

এই বাসগুলো এখন সড়কে চলছে না। এর কারণ হিসেবে বিআরটিসির প্রশাসন ও অপারেশন বিভাগের পরিচালক ড. মো. জিয়াউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা এখন ভায়াবল হচ্ছে না। অনেক কিছুই এখন বন্ধ। তা ছাড়া সিটি করপোরেশনকে আমরা বলেছি এই রুটে রিকশা বন্ধ করে দিতে। রিকশার কারণেই এই সার্ভিস ভায়াবল হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনকে আমরা আরো বলেছি, ভর্তুকি দিলে আমরা এই সার্ভিস অব্যাহত রাখতে পারব। তৎকালীন মেয়র বলেছিলেন, ঠিক আছে জানলাম। তারপর আর কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।’

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় ব্যক্তি- মালিকানায় চলা এক বাস সার্ভিসের সুপারভাইজার আনোয়ার মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমনে দেখলে মনে অয় অনেক যাত্রী, না জানি কত লাভ! কিন্তু ঢাকা শহরে সাধারণ গাড়ি নিয়েই আমগো পোষায় না। আর এইগুলা তো লাগজারিয়াস গাড়ি। সবাই তো লাভের লাইগা গাড়ি চালায়। লাভই যদি না অয় তাইলে ক্যামনে চালায়? গাড়ি সরকারি অইলেও পাবলিক ওইটা নিয়া আইছে ব্যবসা করার লাইগা। ধরেন, গাড়ি সরকার থিকা আমি নিলাম কন্ট্রাক্টে, এমন আরকি। এহন পোষাইতে না পারলে কেমনে চইলবো?’

এই রুটে নিয়মিত চলাচল করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সিফাত আহাম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদিও এই বাস সার্ভিসটি আরামদায়ক ছিল, আমার বেশি চড়া হয়নি। এই বাসে সময় বেশি লাগে। আর কিছুদিন ভালো সার্ভিস দেওয়ার পর অন্য রুটে চলা শুরু করে দিয়েছিল।’

ফারিয়া ফারজানা নামে আরেক শিক্ষার্থী জানান, তিনি আবারও এই বাস সার্ভিসটি চালুর অপেক্ষায় আছেন। কারণ এই সার্ভিসটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং ভালো ছিল।

নাম প্রকাশ না করে বিআরটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হিসাব মতো এসব রুটে চক্রাকার বাসের ভাড়া তুলনামূলক বেশি। প্রথম দিকে এসি বাস, ভালো সার্ভিস, এসব বিষয় চিন্তা করে অনেক যাত্রী পাওয়া গেলেও কিছুদিন পর যাত্রীসংখ্যা কমতে থাকে। যে পথ রিকশায় ৩০ টাকায় যাওয়া যায়, সেই পথটুকু কেউ বাসে ২০ টাকায় যেতে চাইবে না। আর বাসগুলো বেশ বড় হওয়ায় সড়কে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। যানজটে আটকে যাত্রীদের বসে থাকতে হতো। ফলে যাঁরা নীলক্ষেত থেকে ঝিগাতলা বা ধানমণ্ডি যাবেন তাঁরা রিকশায়ই চলে যেতেন। যদি এই রুটে রিকশা বন্ধ করা যেত তাহলে চক্রাকার বাস সার্ভিস লাভজনক হতো। লোকসান দিয়ে বেশি দিন কোনো সার্ভিস অব্যাহত রাখা যায় না।’

সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, রুট রেশনালাইজেশনের অংশ হিসেবে এই সার্ভিসটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছিল। চক্রাকার বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ক্ষোভ রয়েছে। সার্ভিসটি আবারও চালু করে রুট রেশনালাইজেশনের কার্যক্রমে কিভাবে গতি ফিরিয়ে আনা যায় সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৭ মে উত্তরায় দুটি রুটে চক্রাকার বাসসেবা চালু করা। অশোক লেল্যান্ডের ১০টি এসি বাস দিয়ে সার্ভিসটি চালু করা হয়েছিল। চক্রাকার বাসের একটি রুট ছিল, আলাওল এভিনিউর পূর্ব প্রান্ত থেকে হাউস বিল্ডিং, খালপার হয়ে উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়। অন্যটি

ছিল বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিমে থাকা বিভিন্ন সেক্টরের ভেতর দিয়ে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের স্লুইস গেট পর্যন্ত। চালুর কিছুদিন পরই চক্রাকার বাসগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। এতে ভোগান্তির মুখে পড়েন যাত্রীরা। ওই বছরের শেষের দিকে চক্রাকার বাস সার্ভিসটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

চক্রাকার বাস সার্ভিস বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সার্ভিসটি কেন বন্ধ হলো তা বিআরটিসিই ভালো বলতে পারবে। যেহেতু এটা তাদের সার্ভিস, তাই কোন রুটে কিভাবে চালাবে এটা তারাই ঠিক করবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/03/05/1010966