৪ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৯

ব্যর্থ দুই সিটি করপোরেশন

মশার রাজত্বে অতিষ্ঠ ঢাকাবাসী

রাজধানীজুড়ে এখন কিউলেক্স মশার রাজত্ব চলছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন উপদ্রব বেশি চার গুণ। দিনরাত মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। বাসাবাড়ি-কর্মস্থান-কোথাও নিস্তার মিলছে না। কার্যকরভাবে পূর্বপ্রস্তুতি না নেওয়ায় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, শীতের পর হঠাৎ গরম কিউলেক্স মশার প্রজননের খুবই উপযোগী। এ সময় বদ্ধ জলাশয়, কাভার্ড ড্রেন, বক্সকালভার্ট, প্লাস্টিক বর্জ্য ও ডাবের খোসায় জমে থাকা পানিতে কিউলেক্স মশার বংশবিস্তার ঘটছে।

সিটি করপোরেশন এগুলো পরিষ্কারে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। মশার এই ভয়াবহ উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। মশক নিয়ন্ত্রণের কাজে পরীক্ষায় প্রমাণিত নয় ড্রোন প্রযুক্তি। তাই এই সময়ে এদিকে মনোনিবেশ না করে মশার প্রজনন রুখতে জলাধার পরিষ্কার ও লার্ভা নিধনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার বক্সকালভার্ট ও কাভার্ড ড্রেন রয়েছে। যেগুলোয় দুই সিটি মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। আর প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী, পলিথিন, ডাবের খোসাসহ বিভিন্ন আবর্জনায় এই ড্রেনগুলো ভরাট থাকে। যে কারণে ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয় না। জমে থাকা এসব পানিতে কিউলেক্স ভয়াবহরূপে বংশবিস্তার করছে। এসব স্থানে মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না।

এ ছাড়াও জলাশয়, খাল, নর্দমা এবং যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রী ও ডাবের খোসার পানিতে ভয়াবহরূপে মশা বংশবিস্তার ঘটাচ্ছে। মশক নিধনে দুই সিটির পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রয়েছে।

এরপরও নগরবাসীকে মশার ধকল সইতে হবে কেন-এমন প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ৭৭ কোটি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ৩৫ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলার প্রকৃতিতে শীতের পর হঠাৎ করে তাপমাত্রা বাড়ে। এ সময়টা কিউলেক্স মশার প্রজননের জন্য খুবই উপযোগী। একই সঙ্গে পানির ঘনত্ব বাড়ে এবং পানিতে অর্গানিক মেটাল বাড়ে। এখান থেকে কিউলেক্সের খাবার জোগান মেলে। এ কারণে মশার প্রজননমাত্রা বৃদ্ধি পায়।’

তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা শুরু থেকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নগরবাসীকে এমন ধকল সইতে হতো না। ঝড়বৃষ্টি হলে এটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এর আগে প্রজনন স্থানগুলো পরিষ্কার করে লার্ভা নিধনে ওষুধ ছিটানো সম্ভব হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করা সম্ভব। এছাড়া ওষুধ ছিটিয়ে সফলতা পেতে হলে উড়ন্ত মশা মারার ফগিং পরিচালনা কমিয়ে লার্ভা নিধনে লার্বিসাইট ওষুধের ব্যবহার বাড়াতে হবে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, জানুয়ারির শুরু থেকেই রাজধানীতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানীতে মশার উপদ্রব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাজধানীতে এখন রীতিমতো চলছে মশার রাজত্ব। এরপরও দুই সিটি কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করেনি।

ভুক্তভোগীরা জানান, বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, বাজার, উন্মুক্ত স্থান, সড়ক, পার্ক, খেলার মাঠ, মসজিদ-যেখানেই যান না কেন, মশার উপদ্রব থেকে কোনো নিস্তার মিলছে না। দুই সিটির ব্যর্থতার কারণে মশার কয়েল, স্প্রে, মশারি বিক্রিও বেড়েছে। এসব পণ্যের বিক্রি বাড়াতে কৌশলগত কারণে রাজধানীতে মশার উপদ্রব বাড়ানো হয়েছে বলেও সংক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ অভিযোগ তুলছেন।

খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা মানিক মুনতাসির মঙ্গলবার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আর কোনো কথা শুনতে চাই না। আগে মশা মারুন।’ তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ আরেফিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মশাই যদি না মারতে পারেন, তাহলে মেয়র-কাউন্সিলরদের থাকার দরকার কী?’

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ডেঙ্গি ভাইরাসবাহিত এডিস মশা দমনে দুই সিটি করপোরেশন তৎপর ছিল। এ কারণে গত বর্ষার মৌসুমে রাজধানীতে ডেঙ্গি আক্রান্তের হার কম ছিল। সারা দেশে মারা গেছে মাত্র ৬ জন, যেটা ২০১৯ সালে ছিল ২০৫ জন। এডিস নিয়ন্ত্রণে রাখার সফলতার গল্প শুনিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা।

এজন্য নগরবাসী সরকারকে সাধুবাদ দিয়েছেন। মশক নিধনের এ সাফল্যের পর চুপসে যায় দুই সিটির মশক নিধন কার্যক্রম। সেসময় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও। কিন্তু দুই সিটি এসব পরামর্শ আমলে নেয়নি। যে কারণে ধকল সইতে হচ্ছে-এমন অভিমত সংশ্লিষ্ট অনেকের।

রাজধানীর কিউলেক্স মশার প্রজননের ওপর জরিপ কাজ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বা বিগত ১৪ মাসে যে চিত্র এসেছে, সেখানে মশার প্রজনন চার গুণ বৃদ্ধির তথ্য মিলেছে।

এ মহানগরীর ৬টি স্থানে এ জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া, পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার, মোহাম্মদপুরের শ্যামলী, পরীবাগ, সেন্ট্রাল রোড-শাহবাগ, উত্তরা এবং খিলগাঁও-বাসাবো। বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ডিপার মেশিনের সাহায্যে তিনি মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাণ করেন।

এ সময়ের মধ্যে গত জুন, জুলাই ও আগস্টে লার্ভার ঘনত্ব পাওয়া যায় ১০-১৫টি। সেপ্টেম্বর থেকে এ ঘনত্ব ক্রমশ বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে যেটি ৫০-এ পৌঁছেছে। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আগামী মাসে এ চিত্র ৬০-এ পৌঁছাতে পারে বলে জরিপে তথ্য মিলেছে।

কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘আবহাওয়ার কারণে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে কিউলেক্স মশা বাড়ে। এ সময়ে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রজনন উৎস জলাশয়, কাভার্ড ড্রেন ও আবর্জনার কারণে মশার উপদ্রব বাড়ছে। মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে সারা বছর জরিপ পরিচালনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজধানীর মশক নিধন ব্যবস্থাপনায় এখনো সেটা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে রাজধানীর কিউলেক্স মশার প্রজনন স্থানের ওপর জরিপ পরিচালনা করে ৬২৯টি হট স্পট পাওয়া যায়। ২০২০ সালে সেটা করা হয়নি, এটা পরিচালনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হলে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি করা সম্ভব হতো।’

এক প্রশ্নের জবাবে ড. মঞ্জুর বলেন, ‘রাজধানীর কাভার্ড ড্রেনগুলো মশার বড় প্রজননস্থান। বন্ধ থাকার কারণে এসব ড্রেনে মশার ওষুধ ছিটাতে পারে না। ফলে এসব ড্রেন থেকে প্রচুর মশার প্রজনন ঘটছে। এছাড়া রাজধানীর জলাশয়গুলোর কচুরিপানা পরিষ্কার না করার কারণেও প্রচুর মশার প্রজনন হচ্ছে। দুই সিটিকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। জলাশয় কোন সংস্থার, সেটা বিবেচনা না করেই সেসব পরিষ্কারের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ড্রোন ব্যবহার করে মশার প্রজনন করা সম্ভব, এটা প্রমাণিত না। এটা পরীক্ষার বিষয়, তারপর ব্যবহারের চিন্তা করতে হবে। কেননা জলাধারের কচুরিপানা থাকলে সেখানে ওষুধ ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই। আর যত্রতত্র ওষুধ ছিটালে মানুষের বাসাবাড়িতে চলে যাবে। মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। এসব সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

কীটতত্ত্ববিদ একেএম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটির জনবল বৃদ্ধি এবং মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। কেননা ওষুধগুলো সঠিকভাবে ছিটানো হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত না হলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিপর্যায়েও সচেতন হতে হবে।

রাজধানীর ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ অবকাঠামো এবং আবর্জনা পরিষ্কার সম্পর্কে প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজধানীর মোট ড্রেনেজ ব্যবস্থার ৩০ ভাগ কাভার্ড। এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য ও ডাবের খোসায় জমে থাকা পানিতে প্রচুর কিউলেক্স মশার প্রজনন হচ্ছে। কিউলেক্স নিয়ন্ত্রণে এসব আবর্জনা পরিষ্কার ও কাভার্ড ড্রেনগুলো প্রবহমান রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মশার বংশবিস্তার ঘটে বদ্ধ জলাশয়ে, ড্রেনগুলো প্রবহমান থাকলে এ অবস্থার উন্নতি ঘটবে।’

মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা যুগান্তরকে বলেন, ‘আবহাওয়াগত কারণে এখন কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। এ কারণে মশার উপদ্রব কিছুটা বেড়েছে। বিদ্যমান কিউলেক্স মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে ৮ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত ক্র্যাশ কর্মসূচি পরিচালনা করা হবে। অঞ্চলভিত্তিক বিপুলসংখ্যক জনবল এ কাজে সম্পৃক্ত করে পরিস্থিতি উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে।’

একই বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী যুগান্তরকে বলেন, এখন কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। এ কারণে মশার উপদ্রব একটু বেশি। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মশার প্রজনন উৎস ধ্বংসে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আশা করি, ১৫ মার্চের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে।

এদিকে বুধবার রাজধানীর বাসাবো, খিলগাঁও এলাকার খাল পরিদর্শন শেষে কাওরান বাজার পান্থকুঞ্জ পার্ক এলাকায় ব্রিফ করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন কিউলেক্স মশা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ মশাগুলো খুব বিপজ্জনক নয়, তাই এ ব্যাপারে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা সবাই মিলে এ সমস্যা থেকে নগরবাসীকে পরিত্রাণ দিতে কাজ করে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাজধানীর খাল ও নর্দমা পরিষ্কার করতে পারলে এসব মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে।’

একই বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘মশক নিয়ন্ত্রণে আমরা কৌশল পরিবর্তন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আশা করছি, দুই সপ্তাহের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’ এ সময় পর্যন্ত নগরবাসীকে ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘মশক নিধনে ডিএসসিসির সকালের কার্যক্রম চলছে ৪ ঘণ্টা, বিকালেও দীর্ঘ সময় করে এ কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। আর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এপ্রিল থেকে নতুন কৌশলে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/398516