৪ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৫

সরকারের চাল মজুদের নাজুক পরিস্থিতি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: সরকারের গুদামে মজুত বাড়িয়ে বাজারে দাম কমাতে গত বছরের ডিসেম্বরে খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। মন্ত্রণালয় আরও জানায়, বেসরকারি খাতে ১০ লাখ টনের মতো আমদানির সুযোগ দেওয়া হতে পারে। বাজার নিয়ন্ত্রণে না এলে সেটা আরও পাঁচ লাখ টন বাড়বে। ইতোমধ্যে আমদানি করা চাল দেশে আসতে শুরু করলেও দাম কমছে না। বরং আমদানি করা চাল বাজারে আসার পরও বাড়ছে দাম। এতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কমে গেছে বিক্রি। দাম সহসা কমার কোনো ইঙ্গিতও নেই রাজধানীর পাইকারদের কাছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সূত্র বলছে, সরকারের গুদামে এখন চালের মজুত রয়েছে ৫ লাখ ২৭ হাজার টন। যেখানে গত বছর একই সময়ে চাল মজুত ছিল ১৩ লাখ ৮ হাজার টন। অর্থাৎ মজুত কমেছে অর্ধেকেরও অনেক বেশি। ফলে সরকারের চাল মজুদের নাজুক পরিস্থিতি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন চাল কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদন পায়। সেই সঙ্গে চাল কেনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র দাখিলের সময়সীমা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখ থেকে ৪২ দিনের পরিবর্তে ১০ দিন করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয় বৈঠকে। এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি একই কমিটির বৈঠকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কেনাকাটায় দরপত্রের সময়সীমা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তখন বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক টেন্ডার করার পরে ৪০ থেকে ৪২ দিন অপেক্ষা করার কথা বলা ছিল। কিন্তু কিছু পণ্য আছে, যেমন- পেঁয়াজ, চাল, তেল- এ জাতীয় জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই বাড়ে-কমে। সেখানে এত লম্বা সময় কোনো টেন্ডার অপেক্ষা করে না।

আগের আইনে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে দেশীয় বাজার থেকে কিছু কিনলে প্রয়োজনে সময় কমানোর কথা বলা থাকলেও আন্তর্জাতিক কেনাকাটা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ছিল না। সেজন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব আমলে নিয়ে আইএমইডিকে আইন ও বিধি সংশোধনের পরামর্শ দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটি। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা বুঝতে পারলাম আন্তর্জাতিক বাজার অত্যন্ত অস্থির। চাল, তেল, গমসহ এসব জিনিসের দাম উঠানামা করে খুব দ্রুত। সেজন্য কম সময় দরকার এখানে। বেশি সময় দিলে পরে আমরা কমপিটিটিভ প্রাইস পাব না। আন্তর্জাতিক বিডাররা বিড করবে না। সেজন্য আমরা আইনটা সংশোধন করছি।

আইন সংশোধনের পর নতুন করে খাদ্য আমদানি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বছর খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হয়েছে। গতবার বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমদানি করা চাল বাজারে আসার পরও বাড়ছে দাম। এতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কমে গেছে বিক্রি। দাম সহসা কমার কোনো ইঙ্গিতও নেই রাজধানীর পাইকারদের কাছে। চালের ঊর্ধ্বমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণে দেড় মাস আগে দেয়া হয় আমদানির অনুমতি কমানো হয় শুল্ক। বিদেশ থেকে দেশের বাজারে আসতেও শুরু করেছে সেই চাল। তারপরও কমেনি বরং দেশি চালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম বাড়ছে আমদানি করা চালের দামও। বিদেশি চাল বাজারে এলে দাম কমবে; এমন ধারণায় দ্রুত মজুত চাল আগেই বিক্রি করে বিপাকে পড়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। তবে দাম বৃদ্ধির পাইকারি বাজারের প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। এতে দৈনিক বাজারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তারা।

ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে ধানের সংকট থাকায় চালের দামের ওপর প্রভাব পড়েছে। মোটা চালের তুলনায় সরু চালের দাম বেশি বেড়েছে। তবে এলসি করা চালের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। খুচরা বাজারে মোটা চাল স্বর্ণা- পাঁচ ৪৮ টাকা, বি আর আটাশ ৪৫ টাকা, জিরাশাল ৬৫ টাকা, কাটারি ৬৬ টাকা এবং মিনিকেট ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এতে চাল কিনতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা।

খাদ্যমন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খাদ্যশস্যের বাজারমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা রোধ, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে সহায়তা এবং বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে বেসরকারি পর্যায়ে চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২৭ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে চাল আমদানি জন্য বৈধ আমদানিকারকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ১০ জানুয়ারির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শর্তে বেসরকারি পর্যায়ে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৩২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। বাস্তবতা হলো সরকারের গুদামে এখন চালের মজুত রয়েছে ৫ লাখ ২৭ হাজার টন। যেখানে গত বছর একই সময়ে চাল মজুত ছিল ১৩ লাখ ৮ হাজার টন। অর্থাৎ মজুত কমেছে অর্ধেকেরও অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতি দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ন্যূনতম ৮ লাখ টন চালের মজুতকে সরকারের স্থিতিশীল মজুত বলে বিবেচনা করা হয়।

এমন পরিস্থিতির পরও গত বছর থেকে এ পর্যন্ত প্রতি মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। গত বছর বোরো ধান ওঠার পরপরই (গত বছরের এপ্রিল) সরকার নতুন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য ঘোষণা করে। ওই সময় ৩৬ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা কেজিতে আতপ চাল কেনার কথা জানানো হয়। কিন্তু ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো ধান কেনার ৮ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কিনতে পেরেছিল মাত্র ২ লাখ ২০ হাজার টন, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কম। এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি আমন ধান সংগ্রহ কার্যক্রমের। ২ লাখ টন ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ১১৬ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ শতাংশ। এ মৌসুমের সংগ্রহ চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ সময় শেষে লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ পূরণও অসম্ভব। সরকারের এ মজুত দুর্বলতার সুযোগে বাজারে চালের দাম বেড়েই চলছে। ৫০ টাকার নিচে কোনো চাল কিনতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে করোনার কারণে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। যারা উপার্জন করছেন তাদের মধ্যেও অনেকের আয় আগের তুলনায় কমেছে। সেখানে চালের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে আছেন সাধারণ মানুষ। চাল সংগ্রহে সরকারের ব্যর্থতার কারণে বাজারে চালের দাম বেড়ে চলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্বেগের বিষয় হলো চালের এ চড়া দাম স্থিতিশীল নয়, ক্রমেই তা আরও বাড়ছে। মনে রাখা প্রয়োজন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন, সবারই আয় কমেছে, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। আর কোভিডের পাশাপাশি গতবছর ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সুতরাং নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল। প্রধান খাদ্য এবং খাদ্যনিরাপত্তা বলতে সব মানুষের জন্য প্রধান চালের সহজ প্রাপ্যতাই বোঝানো হয়ে থাকে সরকারের উচিত এ বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। চালের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে কোভিডের কারণে আর্থিকভাবে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর বিপন্নতা আরও বাড়বে।

তবে প্রশ্ন উঠেছে কেন বাড়ছে চালের দাম? খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মিলাররা চালের দাম বাড়িয়েছে। ফলে খুচরা ও পাইকারিতে দাম না বাড়িয়ে তাদের উপায় নেই। তবে চালকল মালিকদের দাবি, আমন মৌসুম শেষ হওয়ায় এখন ধানের দাম চড়া। তাই চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া ভোক্তারা এখন সরু চালের দিকে ঝুঁকছে। তাই সরু চালের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের কৃষকরা এখনো মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা চাষাবাদে বেশি আগ্রহী। এ কারণে সরু চালের সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বাড়ছে।

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চালের দাম বাড়াতে মিলারদের অজুহাতের অভাব হয় না। আমন মৌসুমের শুরুতে প্রান্তিক কৃষকরা অনেক কম দামে ধান বিক্রি করলেও তখন তারা চালের দাম কমায়নি। অর্থাৎ তাদের কাছে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে যুক্তি থাকলেও কমানোর ক্ষেত্রে নেই। বর্তমানে দেশের হাটবাজারগুলোতে ধান-চালের ব্যাপক সরবরাহ। তার পরেও দাম বাড়ায় বিস্মিত মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মাত্র ১০ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহ করছে। যা মোট উৎপাদনের তুলনায় খুবই কম। তাই চালের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের যে কথা বলা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ২ কোটি ৮৪ লাখ ১৬ হাজার ৭১০ টন চালের বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন প্রায় ৩ কোটি ৪৪ লাখ টন।

এদিকে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত মাসের শেষের দিকে দেশের বড় মোকামের চালকল মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক। বৈঠকে কোনো অজুহাতে চালের বাজারে যেন অস্থিরতা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য চালকল মালিকদের সতর্ক করা হয়। কিন্তু বৈঠকের পরও চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী।

সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে জানুয়ারি মাসে সাতটি মনিটরিং টিম গঠন করলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে এই টিম কী কাজ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ মজুমদার বারবার বলছেন, কেউ কারসাজি করে চালের বাজার অস্থিতিশীল করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারসাজির সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে পারেনি মনিটরিং টিম।

https://dailysangram.com/post/445537