৩ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১০:২৬

বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে নয়ছয়

দেশে চাহিদার চেয়ে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ। তবুও বহু মানুষ অন্ধকারে। গুণগত মান বজায় রেখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না বহু শিল্পকারখানা। মানহীন নির্মাণকাজের কারণে প্রায়ই সঞ্চালন লাইনে দুর্ঘটনা ঘটছে। এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণে একটি প্রকল্পে বহু অনিয়ম ও অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ও দেখভালের দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। এ সংস্থার অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প ন্যাশনাল পাওয়ার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট (এনপিটিএনডি)। জাইকার অর্থায়নে ২০১৩ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। ইতোমধ্যে কয়েক দফা মেয়াদ বেড়েছে। বেড়েছে ব্যয়ও। এ প্রকল্পের ৬ নম্বর প্যাকেজে ব্যাপক নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে, উল্লিখিত প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে গৃহীত প্যাকেজ-৬-এ ঠিকাদারের গাফিলতি পাওয়া গেছে। দুর্নীতির অভিযোগে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। সঞ্চালন টাওয়ারের পাইলিংয়ে অনিয়ম ধরা পড়েছে। পরিকল্পনায় ভুল ছিল। লাইন নির্মাণের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই মালপত্র ক্রয় করা হয়েছে। সেসব মাল এখন নষ্ট হচ্ছে। পরে সে রুট বাতিল হয়েছে। সাব-কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গেও মূল ঠিকাদারের জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম ঘটেছে। প্যাকেজ-৬-এ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে জাপানি কোম্পানি ফুজিকুরার নেতৃত্বাধীন একটি কনসোর্টিয়াম। অন্য দুই সদস্য হলো কোরিয়ান কোম্পানি এলএস কেবলস ও জাপানের আরেক প্রতিষ্ঠান ইতোচু করপোরেশন।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পিজিসিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঠিকাদার কোম্পানি ফুজিকুরা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনিয়ম করেছে। এসব অনিয়মের কারণে প্রকল্পের ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে (সিঙ্গাপুর) অভিযোগ করেছে স্থানীয় অংশীদার ইমপিরিয়ান নামে একটি কোম্পানি। প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলেও নিজেদের ব্যবসা সংকোচনের আওতায় ঠিকাদার ফুজিকুরা বাংলাদেশ ছাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্নিষ্টরা। এদিকে, প্রকল্পের একটি অংশ বাতিল হওয়ায় কনসোর্টিয়ামের অন্যতম সদস্য এলএস কেবলস মূল ঠিকাদার ফুজিকুরার কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে চিঠি দিয়েছে।

এ বিষয়ে ফুজিকুরার ব্যাখ্যা জানার চেষ্টা করা হয়। পিজিসিবিতে জমা দেওয়া ফুজিকুরার নথিপত্রে কোম্পানিটির প্রজেক্ট অফিসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবন। বক্তব্যের জন্য উল্লিখিত ঠিকানায় গত মঙ্গলবার গিয়ে কোনো অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোম্পানিটির নথিপত্রে যোগাযোগের জন্য প্রজেক্ট অফিসের একটি বাংলালিংক নম্বর দেওয়া আছে। ওই নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এক বিদেশি নাগরিক ফোন ধরলেও নিজের পরিচয় দিতে ও সংশ্নিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তাদের প্রজেক্ট অফিস কোথায়, জানতে চাইলেও সাড়া মেলেনি। সূত্র জানিয়েছে, ওই নম্বরটি ফুজিকুরার বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক জনৈক সারাবানা ব্যবহার করেন। ই-মেইলে যোগাযোগ করার জন্য ফুজিকুরার ওয়েবসাইটে কোনো মেইল অ্যাড্রেস পাওয়া যায়নি।

শুরুর কথা :দেশের সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে এনপিটিএনডি প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১২ সালে। ২০১৩ সালে এটি একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলন করা হয় দুই হাজার ৪২৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার ৩৭৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং পিজিসিবির ২৮০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা জোগান দেওয়ার কথা। বাকি এক হাজার ৭৬৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি পিজিসিবি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সময় বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৫১৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সংশোধিত ডিপিপিতে সরকারের খরচের অংশ বেড়ে হয় ৮০০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আওতায় ১৩টি সাবস্টেশনের (উপকেন্দ্র) মধ্যে ১২টির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ছয়টি উপকেন্দ্রের বে-এক্সটেনশনের মধ্যে চারটি সম্পন্ন হয়েছে। ২২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের মধ্যে ৩০ কিলোমিটারের বেশি এখনও বাকি। আর ২৬ কিলোমিটার হাটহাজারী-রামপুর সঞ্চালন লাইন বাদ দেওয়া হয়েছে।
এনপিটিএনডি প্রকল্পটি ১০টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে প্যাকেজ-৬-এর আওতায় ছিল- হাটহাজারী-শিকলবাহা-আনোয়ারা ৪৫ কিলোমিটার; হাটহাজারী-রামপুর ওভারহেড ২৪ কিলোমিটার এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ৮ কিলোমিটার; মোট ৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কার্যক্রম। এনপিটিএনডি একনেকে অনুমোদন পাওয়ার দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ২ মার্চ ২৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্যাকেজ-৬-এর দরপত্র আহ্বান করা হয়। মোট ১১টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র কেনে। তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। এর মধ্যে ফুজিকুরা চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়। ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল এতে জাইকার সম্মতিও পাওয়া যায়। ওই বছর ৩ মে ফুজিকুরা লিমিটেডের আর্থিক প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে খোলার পর দেখা যায়, সেখানে প্যকেজ-৬ প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৭০ কোটি টাকা, যা ডিপিপিতে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ১৩২ শতাংশ বেশি। সংশ্নিষ্টরা জানান, কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই ফুজিকুরার প্রস্তাবিত অর্থে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় পিজিসিবি। চুক্তি অনুসারে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে দুই বছরের মধ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। দুই দফা সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ এখন ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ঠিকাদার হিসেবে কার্যাদেশ পেলেও ফুজিকুরা এ প্রকল্পের মালপত্র সরবরাহ করেছে।

পরিকল্পনায় ত্রুটি :প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, রুট নির্ধারণে গাফিলতি। জানা গেছে, রুট নির্ধারণের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্পের সঙ্গে স্বার্থসংশ্নিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিভাগ, সংস্থা এজেন্সি ও কোম্পানি, যেমন- রেলওয়ে, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি, কর্ণফুলী ইপিজেড, কাফকো এবং সিইউএফএলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় করা হয়নি। ফলে নির্মাণকাজ পদে পদে বাধার মুখে পড়ে, তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রতা। সঞ্চালন লাইনের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির মালিকরাও অধিকাংশ ক্ষতিপূরণ পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হাটহাজারী-রামপুর সঞ্চালন বাতিল :রামপুর ও আগ্রাবাদ বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে এই সঞ্চালন রুট ঠিক করা হয়েছিল। গত বছরের ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত এনপিটিএনডি প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, সরকারি একটি সংস্থার আপত্তির কারণে হাটহাজারী-রামপুর ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা রক্ষায় ওই এলাকা দিয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করার ব্যাপারে সম্মত হয়নি ওই সংস্থা। বিকল্প পথে লাইনটি নির্মাণ করতে হলে এর দৈর্ঘ্য বেড়ে যায় এবং তা বাস্তবায়নে আরও দুই বছর সময় লাগবে বলে জানায় পিজিসিবি। এ জন্য বাড়তি ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। পিজিসিবির এমন প্রস্তাবে সায় দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ বিভাগ। হাটহাজারী-রামপুর ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনটি বাদ দিয়ে প্রকল্প ২০২১ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর হাটহাজারী-রামপুর লাইনটি পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো প্রকল্পভুক্ত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সূত্রমতে, এসব সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে নিলে প্রকল্প বাস্তবায়নে এ রকম সমস্যা হতো না। যেনতেনভাবে রুট নির্ধারণ করায় এ ক্ষতি হলো। এর দায় পিজিসিবি এড়াতে পারে না।

কেনাকাটায় গচ্চা :হাটহাজারী-রামপুর সঞ্চালন ফেইজটা বাতিল হওয়ায় সরকারের গচ্চা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের জন্য অনেক মালপত্র কেনা হয়েছে। সরবরাহকারী ফুজিকুরার দাবীকৃত বিলও পরিশোধ করে পিজিসিবি। অথচ প্রকল্প এলাকায় এসব সরঞ্জাম ও মালপত্র দীর্ঘদিন অব্যবহূত পড়ে আছে। যেখানে নির্মাণ লাইনের রুটই চূড়ান্ত হয়নি, সেখানে মালপত্র কেনাকাটার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পের কোনো কাজে আদৌ ব্যবহার হবে কিনা তা চূড়ান্ত না হলেও এসব মালপত্র পরিদর্শন আর কেনাকাটার অজুহাতে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। যদিও পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া দাবি করেছেন, মালপত্র কেনা হয়নি। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর ও ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল হাটহাজারী-রামপুর প্রকল্পের জন্য আমদানি করা সরঞ্জাম চট্টগ্রাম বন্দরে পিজিসিবির প্রতিনিধি দল পরীক্ষা করেছে। এর প্রমাণ রয়েছে। রূপালী ব্যাংকে খোলা এলসির মাধ্যমে জাপান ও ফ্রান্স থেকে এসব মালপত্র বাংলাদেশে আনে ফুজিকুরা। ২০১৭ সালের নভেম্বরের এলসিতে হাটহাজারী-রামপুর অংশের জন্য প্রায় আট কোটি ৩০ লাখ টাকার মালপত্র জাপান থেকে আনা হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিলের এলসিতে এক কোটি ৮৯ লাখ টাকার মালপত্র ফ্রান্স থেকে আনা হয়। এর বাইরেও কয়েক দফা কেনাকাটা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে পিডি নিয়োগ :শুরুতে এনপিটিএনডির প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান পিজিসিবির কর্মকর্তা মাহবুব আহমেদ। যিনি এর আগে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঈশ্বরদী-বাঘাবাড়ী-সিরাজগঞ্জ-বগুড়া এবং সিলেট-শাহজীবাজার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাহবুব আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রথম অভিযোগ ওঠে ২০১০ সালে। পরে তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় গুলশান থানায় মামলা করা হয়। তাকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। একই বছর উচ্চতর কমিটির জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুব আহমেদসহ তার ছয় সহযোগী চেক জালিয়াতির মাধ্যমে দুটি প্রকল্প থেকে ৬৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তদন্ত কমিটি আরও জানায়, প্রকল্পের প্রধান হিসেবে মাহবুব আহমেদের আট মাসের দায়িত্ব পালনকালে দুটি প্রকল্পে শুধু তার হাত দিয়েই জালিয়াতি করা হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও এ জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর আদালতে এ বিষয়ে চার্জশিট দাখিল করে দুদক।

সংশ্নিষ্টরা প্রশ্ন তোলেন, দুর্নীতির দায়ে নিজেদের তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়া এবং দুর্নীতির একটি মামলা চলমান থাকার পরও কীভাবে মাহবুব আহমেদকে এনপিটিএনডির মতো বড় প্রকল্পের পিডি হিসেবে নিয়োগ দেয় পিজিসিবি কর্তৃপক্ষ! যদিও ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ওই বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত তাকে ছুটিতে পাঠিয়ে পরে প্রকল্প পরিচালকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।

আরও অনিয়ম :প্রকল্পে চলমান হাটহাজারী-শিকলবাহা সঞ্চালন লাইনে মোট ৮৫টি টাওয়ার বসানো হচ্ছে। প্রতিটি টাওয়ারের জন্য প্রয়োজন হয় ১৬-৩৬টি পাইল। এ লাইনে মোট পাইলিংয়ের পরিমাণ দুই হাজার ১০০। সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের কার্যাদেশে প্রতিটি পাইলিং গড়ে ৩০ মিটার গভীর করার কথা থাকলেও পাইলিং করা হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ মিটার গভীর। এভাবে প্রতিটি পাইলিংয়ে আত্মসাৎ করা হচ্ছে কোটি টাকা। অপকর্মটি আড়াল করতে পাইলিংয়ের মাপ পরীক্ষার জন্য পিজিসিবি অনুসরণ করছে পিআইটি (পাইল ইন্টিগ্রেটি সিস্টেম) পদ্ধতি, যাতে কারসাজি করা সম্ভব। অথচ নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি পিএসআইটি (প্যারালাল সিসমিক ইনস্ট্রুমেন্টাল টেস্ট) পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে প্রতিটি পাইলিংয়ের প্রকৃত গভীরতা জানা সম্ভব। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এভাবে পাইলিংয়ে চুরির কারণে আর্থিক লোকাসনের পাশাপাশি টাওয়ার স্থাপনাটিও ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ফুজিকুরার প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় ১০০ দিনের একটি পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এতে বলা হয়েছে, ঠিকাদারি (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডিজাইন প্রকিউরমেন্ট কনস্ট্রাকশন-ইপিসি) ব্যবসায় লোকসানের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান প্রকল্পের কাজ ১০০ দিনের মধ্যে গুটিয়ে নেবে ফুজিকুরা। এ জন্য অনেকে আশঙ্কা করছেন, প্রকল্প কাজ শেষ না করেই ফুজিকুরা বাংলাদেশ ছাড়তে পারে। সম্প্রতি পিজিসিবির রামপাল থেকে নির্মিত একটি সঞ্চালন প্রকল্পে এমন ঘটনা ঘটেছে। একটি ভারতীয় কোম্পানি কাজ সম্পন্ন না করেই ইপিসির পুরো অর্থ তুলে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। পরে পিজিসিবি অন্য পার্টনারের সহযোগিতায় ওই প্রকল্পের কাজ শেষ করে।

এ ছাড়া করোনা মহামারির শুরুতে বাংলাদেশ ত্যাগের পর ফুজিকুরার কোনো জাপানি কর্মী আর ফিরে আসেনি। তারা জাপানে বসে প্রকল্পের কাজ তদারকি করছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন সারাবানা পেরুমাল নামে একজন ভারতীয় নাগরিক, যার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন শিবা মুরুগান নামে আরেকজন।

পিজিসিবির বক্তব্য :জানতে চাইলে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া সমকালকে বলেন, করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। জাপানিরা কবে আসবে, বলা যাচ্ছে না। অন্য পার্টনারদের সহযোগিতায় দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, রুট নিয়ে ঝামেলা থাকায় হাটহাজারী-রামপুর অংশের কাজ বতিল করা হয়েছে। পরে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে এটি নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, যেহেতু একটি অংশের কাজ বাতিল হয়েছে, তাই ঠিকাদার পুরো অর্থ পাবে না। বাতিল হওয়া অংশের জন্য কোনো মালপত্র খরিদ করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। কিবরিয়া বলেন, রুট চূড়ান্ত না হলে তো নকশা প্রণয়ন করা যায় না। ফলে কেনাকাটা হওয়ার কথা নয়। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পিডি নিয়োগ প্রসঙ্গে পিজিসিবির এমডি বলেন, এটা তার দায়িত্ব পাওয়ার আগের ঘটনা। তাই এ সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

https://samakal.com/bangladesh/article/210354526/