৩ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১০:২৫

টোলের নামে চাঁদাবাজি

ডিএসসিসির রাস্তা ইজারা দেয়া হয়েছে টার্মিনালের নামে

গাড়ি দেখলেই দৌঁড়। চলন্ত গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জোর করে থামানোর চেষ্টা। এরপর টোল দাবি। দিলে ভালো। না দিলেই ঝামেলা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এভাবে দিনের পর দিন অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই টোল আদায় করে যাচ্ছে ইজারাদারের লোকজন। মাস খানেক আগেও যাত্রাবাড়ীতে টোল আদায় করতে গিয়ে খোকন নামে এক যুবক গাড়ির চাকার পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। টোল আদায়কারীদের দেয়া তথ্য মতে, গত ৫ মাসে একইভাবে মারা গেছে কমপক্ষে ৫ জন। অভিযোগ উঠেছে, বাস টার্মিনালের নামে সমগ্র সিটি করপোরেশন এলাকার রাস্তাঘাট ইজারা দেয়া হয়েছে। টোলের নামে চলছে চাঁদাবাজি। সেই টোল আদায় করতে গিয়েই অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। একই সাথে গাড়ির মালিক ও চালকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় নামমাত্র বাস টার্মিনাল রয়েছে তিনটি। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গুলিস্তান-জয়কালি মন্দির ও ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনাল। যদিও এসব টার্মিনালে নেই ন্যুনতম সুযোগ সুবিধা। তবুও বছরের পর বছর ধরে এসব স্থান বাস টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ডিএসসিসি নিজস্বভাবে এসব টার্মিনাল থেকে রাজস্ব আদায় করতো। স¤প্রতি এসব টার্মিনাল ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসসিসি। এ সিদ্ধান্তে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সমগ্র এলাকা। অর্থাৎ এবারই প্রথমবারের মতো ডিএসসিসির সব রাস্তা অঘোষিত টার্মিনালে পরিণত হয়েছে। আর এসব রাস্তায় কোনো বাস/মিনিবাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি, অটোরিকশা ও ট্রাক চলাচল করলেই দিতে হবে টোল। আর এ টোল আদায়ের নামে গণহারে চলছে চাঁদাবাজির উৎসব। ভুক্তভোগী মালিক ও চালকদের এমনই অভিযোগ।

জানা গেছে, গত প্রায় ১৩ বছর ধরে ডিএসসিসি এলাকায় ওই তিনটি বাস টার্মিনাল থেকে রাজস্ব আদায় করতো করপোরেশনের পরিবহন বিভাগ। কিন্তু এতো বছর এসব টার্মিনাল থেকে কাঙ্খিত টোল বা ইজারার অর্থ আদায় করতে পারেনি ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ। তাই গত বছর এসব টার্মিনাল নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত বছরের অক্টোবরে এ তিনটি টার্মিনাল ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসি।

দরপত্রে অংশ নিয়ে গত ১১ নভেম্বর গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির স্টপওভার টার্মিনালটি ইজারা পায় গুলশান চাকা লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল ফি ও কুলিমজুরি খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ২ কোটি ৯৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকায় টার্মিনালটি ইজারা পায়। কিন্তু গুলিস্তান-জয়কালী মন্দির এলাকা ইজারা হিসেবে পেলেও ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটিকে- মতিঝিল, কমলাপুর, জুরাইন, কদমতলী, পোস্তাগোলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল, মেরাদিয়া, নন্দীপাড়া, মাদারটেক ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকেও টোল আদায়ের অনুমতি দিয়েছে ডিএসসিসি। এ জন্য এসব এলাকায় কোনো বাস ও মিনিবাস প্রবেশ করলেই ৬০ টাকা করে টোল আদায় করছে ইজারাদার। সেই সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পু এবং ট্রাক থেকেও টোল আদায় করছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এসব এলাকা কোনো টার্মিনাল হিসেবে অন্তভুর্ক্ত নয়। তবুও পরিবহন মালিকরা টোল পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন ইজারাদারদের চাপে। কারণ এসব এলাকায় চলাচলকারী সব ধরনের পরিবহন থেকে টোল আদায়ে সাব-ইজারা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মূল ইজারাদার ঢাকা চাকার লিমিটেডের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, ইজারা পাওয়ার পর মূল ইজাদার ঢাকা চাকার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব মাসুদ আবার এলাকাভিত্তিক সাব-ইজারাদার নিয়োগ দিয়েছেন মোটা অংকের টাকা নিয়ে। আর এ কারণেই এলাকা ভিত্তিক সাব-ইজারাদাররা আপসে টোল আদায় করতে না পারলে চাপ প্রয়োগ, এমনকি মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা চাকা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফতাব মাসুদ বলেন, এ সব এলাকা থেকে আমরা আমাদের নিজস্ব লোক দিয়ে টোল আদায় করি ডিএসসিসির দেওয়া নিয়মানুযায়ী। ফুলবাড়িয়া স্টপওভার বাস টার্মিনালেও দেখা গেছে একই চিত্র। এখানেও শুধুমাত্র ফুলবাড়িয়া এলাকার টার্মিনাল হিসেবে ইজারা দেয়া হয়েছে মিনহাজ এন্টারপ্রাইজকে। কিন্তু এ টার্মিনালটির বাহিরেও ইজারার টোল আদায় করা হচ্ছে- গোলাপশাহ মাজার, টিএনটির সম্মুভভাগ, বঙ্গবাজার, চাঁনখারপুল, ফজলুল হক মুসলিম হল সম্মুভভাগ, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নয়াবাজার, বাবুবাজার, আজিমপুর, নিউ মার্কেট, বকসি বাজার, দয়াগঞ্জ, শনির আখড়া, সিদ্দিক বাজার সড়ক থেকে একেবারে ধানমন্ডি পর্যন্ত। এ সব এলাকার কোথাও নেই টার্মিনাল সুবিধা। তবুও ইজারাদারদের চাপে বাধ্য হয়ে টোল পরিশোধ করতে হয় পরিবহন মালিকদের। ফুলবাড়িয়া মার্কেটের একজন পাইকারি বিক্রেতা রহমত আলী বলেন, ইজারার নিয়ম অনুয়ায়ী যদি কোনো যাত্রী মালামাল উঠানো বা নামানোর জন্য কুলিদের সাহায্য চায় তবে সেজন্য টোল পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু যদি কুলির সাহায্য না লাগে তাহলে টোল দিতে হবে না। অথচ ইজারাদার ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালটি ইজারা পাওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও টোল আদায় করছে। কোনো কুলির সাহায্য নিলেও টোল দিতে হয়। না নিলেও টোল দিতে হবে তাদের এমন নির্দেশ। তারেক নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, এসবের প্রতিবাদে গত বছরের ২০ অক্টোবর আমরা বিক্ষোভ করেছিলাম। পাশাপাশি মেয়রকে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু সমাধান হয়নি এখনও।

এ সব বিষয়ে ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগের মহা-ব্যবস্থাপক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ঢাকাকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণের যে কোনো সড়ক গাড়ি চলাচল করতে হলে টোল দিতে হবে। একবার টোল দিলে আরেকবার দিতে হবে না। তবে ফিরতি পথে ফের টোল দিতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/362148/