৩ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১০:২২

গ্রাহক অভাবে বিকল্প বিনিয়োগে যাচ্ছে অনেক ব্যাংক

মহামারি করোনায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবসায়ীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করেছেন। এমন অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকবিমুখ হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার গ্রাহকও পাচ্ছে না। ফলে ঋণ প্রবাহে কমে গেছে গতি। বিনিয়োগ মন্দায় ঋণ নেওয়ার লোক পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বাধ্য হয়ে বিকল্প বিনিয়োগে যেতে হচ্ছে তাদের। আর এই বিকল্প বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করতে মূলধন সংরক্ষণে ছাড়ও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

জানা গেছে, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও বিকল্প বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণে ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন বিকল্প বিনিয়োগে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ঝুঁকিভার ১৫০ টাকা ধরে ১০ শতাংশ বা ১৫ টাকা মূলধন সংরক্ষণ করতে হতো। এখন ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে তার ঝুঁকিভার ১০০ টাকা ধরে ১০ শতাংশ বা ১০ টাকা মূলধন রাখতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ’ এ সংক্রান্ত একটি সাকুর্লারও জারি করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে এ খাতে ব্যাংকগুলোর মূলধন সংরক্ষণের চাপ কমবে এবং বিকল্প বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে। এর আগে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততা নিয়ে ২০১৪ সালে নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালার আওতায় কোন খাতে বিনিয়োগে ঝুঁকিভার কী হারে হবে, সেটি নির্ধারণ করা হয়। এতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিপরীতে ঝুঁকিভার ১৫০ শতাংশ আরোপের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশে বিকল্প বিনিয়োগ খাতের প্রসারের স্বার্থে ভেঞ্চার ক্যাপিটালসহ বিকল্প বিনিয়োগের আওতাভুক্ত সব খাতে বিনিয়োগের বিপরীতে ১০০ শতাংশ হারে ঝুঁকিভার নির্ধারণ করা হয়। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ নির্দেশনা বলবৎ থাকবে। বাংলাদেশে নতুন এই বিকল্প বিনিয়োগকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, বিকল্প বিনিয়োগ বা প্রাইভেট ইক্যুইটি এবং ইমপ্যাক্ট ফান্ড। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০১৫ সালের জুনে অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট বা বিকল্প বিনিয়োগ আইন ২০১৫ প্রকাশ করে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোতে আমানত আসার প্রবণতা বাড়লেও তারা সেইভাবে বিনিয়োগ করতে পারছে না। যদিও আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কিন্তু নিশ্চিত মুনাফা ও নিরাপদে টাকা ফেরতের আশায় সাধারণ মানুষ ব্যাংকগুলোতেই টাকা রাখছে। এছাড়া এই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহও বেড়েছে। এই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নিয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংকের হাতে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে ব্যাংকের হাতে তারল্য বেড়ে গেছে। এ ছাড়া মহামারির মধ্যে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি ও আমানতের প্রবৃদ্ধিতে গতি আসাও তারল্য বাড়াতে সহায়তা করেছে। এর বাইরে নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানোর ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে তারল্য বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে ব্যক্তি খাতের ঋণ বিতরণ বাড়েনি। এছাড়া কমে গেছে ট্রেজারি বিল-বন্ডের বিপরীতে আয়ের পরিমাণও। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সতর্ক থাকছে। যে কারণে করোনাকালে তারল্যের পরিমাণ বেড়ে গেছে রেকর্ড পরিমাণ।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমত, আমানত বেড়ে যাওয়া ছাড়াও বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে ব্যাংকে তারল্য বেড়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, সিআরআর কমানোর ফলে নগদ টাকা বেড়েছে। তৃতীয়ত, রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার কারণেও তারল্য বেড়েছে। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন পুরোপুরি হলে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত গতি ফিরলে, ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য কমে আসবে।

জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংকই এখন নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু ঋণ দেওয়া হচ্ছে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে। কারণ, এখন ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতে এত কম প্রবৃদ্ধি এর আগে কখনও হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মহামারির কারণে অধিকাংশ ব্যাংক দেখেশুনে বিনিয়োগ করছে। অনেকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। যে কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধি রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হলে তবেই ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে আসবেন। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরা ব্যাংকবিমুখ। যে কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করছেন। এমন অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার গ্রাহকও পাচ্ছে না। ফলে ঋণ প্রবাহে কমে গেছে গতি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএ’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, ব্যবসায়ীরা এখনও টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। অনেকেই ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন বলেও জানান তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে টিকে থাকাই দায়, সেখানে ঋণের বোঝা মাথায় নিতে কে চায়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগেরই ঋণ আমানতের অনুপাত ৮০ শতাংশের নিচে রয়েছে। ৫১টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার মধ্যে রয়েছে। অগ্রণী, রূপালী, সোনালীসহ ৫ ব্যাংকের এডিআর ৬০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। মাত্র সাতটি ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য দুই লাখ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আলোচিত সময়ে ব্যাংক খাতে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এ অংক অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেশি। অতিরিক্ত তারল্য থেকে বাচার জন্য ভালো গ্রাহক খুঁজছে অনেক ব্যাংক। তারল্যের চাপ সামলাতে কোনও কোনও ব্যাংক সুদ হারও কমিয়েছে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) জুলাই-ডিসেম্বর এই ছয় মাসের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বাজারে অর্থ সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেসরকারি ঋণ চাহিদা বাড়েনি। প্রতিবেদনে অর্থনীতির সূচক বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। এজন্য অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ইতিবাচক ধারা বইছে। অর্থনীতিতে সুবাতাস হচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৩৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ২০৪ কোটি ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এই সময়ে ১৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয় শিল্প খাতে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। পাশাপাশি এই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। আদায় পরিস্থিতি গত অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। সার্বিকভাবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কম ছিল। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম হওয়ার কারণে এই সময়ে বিনিয়োগ কমেছে। পাশাপাশি শিল্প-কারখানাও পুরোদমে চালু হয়নি।

শিল্প খাতের উৎপাদন পরিস্থিতি বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যম ও বড় পর্যায়ের শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে উৎপাদনের সূচক ৪৪০ দশমিক ২১ পয়েন্টে উঠেছে। ২০১৯ সালের এই সময়ে এই খাতে উৎপাদনের সূচক ছিল ৪১১ দশমিক ৬০ পয়েন্ট। উদ্যোক্তাদের মতে, লকডাউন তুলে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিকতা ফিরে পাচ্ছে। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান এখনও পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতায় কাজ করছে না। এছাড়া আরও অনেক খাত এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা ফিরে পায়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমেছে। শুধু ডিসেম্বর টু ডিসেম্বর মাসভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হারও কমেছে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

https://dailysangram.com/post/445450