৩ মার্চ ২০২১, বুধবার, ১০:২১

গণতন্ত্রের আর্তনাদ ও স্বাধীন গণমাধ্যম

আধুনিক বিশ্বকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব হিসেবেই মনে করা হয়। কারণ, বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আদর্শ শাসন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আধুনিক গণতন্ত্রে কিছু কুফলের কথা বলা হলেও সুফলই বেশি। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, দীর্ঘকাল-পরিক্রমায় গণতন্ত্রের ক্রান্তিকাল এখনও কেটে যায়নি। মূলত আধুনিক গণতন্ত্রের প্রধান নিয়ামকই হচ্ছে ভিন্নমতের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন। যে সমাজে ভিন্নমতের কদর নেই, সে সমাজ কখনোই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। তাই পরমতসহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতের প্রতি সম্মানপ্রদর্শন ছাড়া গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনো অর্থবহ ও সার্থক হয়ে ওঠে না। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে এসব ক্ষেত্রে রয়েছে বড় ধরনের বিপত্তি। ফলে গণতন্ত্রের আহাজারি ও আর্তনাদই নিত্যসঙ্গী হয়েছে বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের।

মূলত সুচিন্তিত বিবেচনার মাধ্যমে ভিন্ন চিন্তা-চেতনাকে সহনীয় পর্যায়ে স্থান দেয়ার নাম পরমতসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্রের সকল শ্রেণি, পেশা, দলমত ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শনও এর অন্তর্ভুক্ত। কোন সমাজে ভিন্নমতের অনুশীলন ও চর্চা না হলে সে সমাজকে সভ্য ও গণতান্ত্রিক বলার সুযোগ থাকে না। দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাষায়, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমি জীবন দিতেও কুন্ঠিত নই’। মূলত এটিই গণতন্ত্র ও সভ্যতার মানদণ্ড।

বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের শাসনপদ্ধতি অতীতে চালু থাকলেও সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক বিশ্ব গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় শামিল হয়েছে। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানেরও অন্যতম মূলনীতি ও রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ। আর গণতন্ত্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হচ্ছে বাকস্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যম। গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে মনে করা হয়। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, স্বাধীনতার পাঁচদশক অতিক্রান্ত হলেও আমাদের দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদের কাছে এখনও অধরাই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশের গণমাধ্যমের চলমান ক্রান্তিকাল সেদিকেই অঙ্গলি নির্দেশ করে।
স্বাধীন দেশে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ কালাকানুন জারি করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশনা ও প্রচারণা। এমনকি ভিন্নমতের কারণে গণমাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলা, সম্পাদকসহ সাংবাদিক নাজেহাল, হয়রানিমূলক মামলার ঘটনাও নেহাত কম নয়। সে ধারাবাহিকতায় সরকারের রোষানলে আমাদের দেশের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক কারান্তরীণ রয়েছেন। সম্প্রতি ভিন্নমত প্রকাশের কারণে দীর্ঘ কারাভোগের পর কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছেন লেখক মোস্তাক আহমেদ। যা আমাদের দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন গণমাধ্যম ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর নতুন করে কালিমা লেপন করা হয়েছে।

জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার বিষয়টি অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম অতীতে যেমন শৃঙ্খলমুক্ত ছিল না; এখনও নয়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ধারাবাহিকতায় সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনির মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণার একটা অনাকাক্সিক্ষত প্রবণতা অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি। ঞযব ঘবংিঢ়ধঢ়বৎ (অহহড়ঁহপসবহঃ ঙভ ফবপষধৎধঃরড়হ) অপঃ-১৯৭৫ মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধের ঘটনাও কারো অজানা নয়। এছাড়াও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য অতীতে প্রণীত হয়েছিল নানা ধরনের কালাকানুন। অবশ্য ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণমাধ্যম কর্মীদের অব্যাহত দাবির মুখে আন্দোলনরত রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা অনুযায়ী জরুরি ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ সংশোধন, ১৬, ১৭ ও ১৮ ধারাসমূহ বাদ দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছিল। তবে পরিতাপের বিষয় যে, পরবর্তীতে নানা ধরনের কালাকালুন প্রণয়নের মাধ্যমে সে অবস্থার বিচ্যুতি ঘটানো হয়েছে। ফলে গৃহীত আইনগুলোর মৌলিকত্ব আর টিকে থাকেনি। উল্লেখ করা দরকার যে, বেসরকারি টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সাল থেকে হলেও এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো স্বাধীন গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারছে না বরং তাদের পদচারণা একটা সঙ্কীর্ণ বৃত্তের মধ্যেই রয়ে গেছে।

অবশ্য বর্তমান সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৩ এর খসড়া প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ সর্বসাধারণের মতামত প্রদানের সুযোগ দেওয়ায় একটা নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি। কারণ, সরকার যে বিষয়েই বিধিপ্রণয়ন করছে বা করেছে তা তাদের ক্ষমতার অনুকূলেই করা হচ্ছে। দেশ, জাতি, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমসহ ব্যক্তিপর্যায়ে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসমূহ বড় ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিপ্লব ঘটিয়েছে বলা যায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা মোটেই ইতিবাচক নয়। ফলে আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি।

দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়ায় আমাদের গণতন্ত্রের পথচলাও নির্বিঘ্ন হয়নি। ফলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতন্ত্রের অনুষঙ্গগুলোও ক্রমেই দুর্বল হতে দুর্বলতর হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসছে। অভিযোগ উঠেছে যে, শুধুমাত্র ভিন্নমতের কারণে গত ১১ বছরে সরকার এবং সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হাতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একই কারণে ৩৬ লাখ মানুষকে বিভিন্ন মামলার আসামী করে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। মামলা দেয়া হয়েছে এক লাখ আট হাজার চৌদ্দটি। ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সরকার এবং সরকারদলীয় লোকজনদের হাতে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৯২৬ জন। গুম হয়েছেন ১০২৮ জন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও সরকার তাদের এই দাবি নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি।

আমাদের দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা রুশোর খেদোক্তির কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলতে রাজী হননি। তার ভাষায়, জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন নিজেদের স্বার্থে। তিনি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন, যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। পক্ষান্তরে প্লেটো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সবচেয়ে অযোগ্য শাসনব্যবস্থা মনে করতেন। তার মতে, যেহেতু গণতন্ত্র বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা সেহেতু গণতন্ত্র কখনই উন্নতমানের শাসনব্যবস্থা নয়। কারণ প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রেই বিজ্ঞানী, সুপন্ডিত এবং যোগ্য লোকের তুলনায় অযোগ্য, অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। তাই বেশিরভাগ লোকের শাসন অর্থই অযোগ্য লোকের শাসন। গণতন্ত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণে নয়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে এসব কথা শ্রুতিকটূ মনে হলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা একেবারে উপেক্ষা করার মত নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই যুৎসই।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও উদার গণতন্ত্র চর্চার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও আমাদেরকে গণতন্ত্র ও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হয়নি। গণতন্ত্রে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার কথা থাকলেও এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন যৎসামান্যই। মূলত শাসনকাজে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা না গেলে সে সমাজ আর গণতান্ত্রিক থাকে না। এক্ষেত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটিসবার্গ এড্রেস’ বেশ প্রাসঙ্গিক। তার ভাষায়, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’ আর এটিই তো আধুনিক গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র।

মূলত আমাদের দেশের প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণের শাসনের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগটা একেবারেই সর্বসাম্প্রতিক নয়। বরং যতই দিন যাচ্ছে সে অভিযোগটা আরও জোরালো ভিত্তি পাচ্ছে। নিকট অতীতে জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থারও গুরুতর অবনতি ঘটেছে। জনগণের ভোট দেয়ার অধিকারটাও কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচন তার জ¦লন্ত প্রমাণ। যা দেশের মানুষ শুধুই হতাশ করেনি বরং উদ্বিগ্নও করে তুলেছে।
গণতন্ত্রের পথচলা বেশ প্রাচীন। এখন থেকে হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল ক্ষুদ্রায়তন এবং স্বল্প জনসংখ্যার। সে কারণে সভা-সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মতামত নেয়া সম্ভব ছিল। এটাই ছিল প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় রাজ্যসমূহের আয়তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। ঘটেছে প্রাচীন যুগের নগর রাষ্ট্রের বিলুপ্তি। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোর বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে সকল জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভব নয়। কাজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের হয়ে, জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের মুখপাত্র এবং তাদের অভিমতকে জন অভিমত বলে মনে করা হয়। তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে আশা করা হয়। এটাকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি।

বাংলাদেশে সাংবিধনিকভাবেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু আছে। তাই এদেশে জনগণ প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই এর যথাযথ প্রয়োগটা বারবারই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও আমরা এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি চালু করতে পারিনি। তাই আমাদের দেশের নির্বাচনগুলো জনমতের যথাযথ প্রতিফলন ঘটছে না বলে জোরালো প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের রাজনীতির সাথে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে।

সঙ্গত কারণেই প্রচলিত গণতন্ত্রের সুবিধাভোগীদের দেশ ও জনগণকে নিয়ে ভাববার তেমন অবকাশ থাকছে না। একথা বললে অত্ত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে অনেক আগেই। ক্ষমতাসীনদের একটি বৃহৎ অংশ জনগণের কল্যাণে কাজ করার পরিবর্তে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকছেন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বিদেশ ভ্রমণ, করমুক্ত গাড়ি আমদানি আর রাজউকের প্লট নিয়ে । নিজেদের স্বার্থেই একই রাস্তা প্রতিবছর বানানো হয়, একই ড্রেন প্রতিবছর কাটা হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে প্রতিবাদের সুযোগটাও বেশ সমস্যাসঙ্কুল। মূলত দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অনুপস্থিতির কারণেই রাষ্ট্রের কোন ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা নেই। সঙ্গত কারণেই পুরো দেশটাই এখন ‘মগের মুলুক’এ পরিণত হওয়ার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। শৃঙ্খলিত গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার অভাবেই এসব ক্ষেত্রে কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সুশাসনের আশাবাদটা আজও আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে।
সন্দেহ নেই, অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ থাকে। আর এ সুযোগ যেখানে থাকে সেখানে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। আর এটিই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য। ভোটের মাধ্যমে জনগণ মতপ্রকাশে বা সঠিক রায় প্রদানে ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা এখন ভোট দানের অধিকার শুধু নয় বরং স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারও হারাতে বসেছি। অনাকাক্সিক্ষতভাবে গণমাধ্যমগুলোকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার মহড়াও প্রত্যক্ষ করছি। যা গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য মোটেই সহায়ক নয়।

মূলত, দেশের শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রতিফলনই হচ্ছে গণতান্ত্রিক শাসন। আর গণতন্ত্রে ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিষয়টি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন মোটেই আশাবাদি হওয়ার মত নয়। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন গণমাধ্যম বন্ধ, সময়ে সময়ে বিভিন্ন কালাকানুন, গণমাধ্যমে অফিসে হামলা, সম্পাদক নাজেহাল, গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক হামলা, গ্রেফতার, কারাদণ্ড সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে লেখক মোস্তাক আহমেদের মৃত্যু এসব অভিযোগকে আরও জোরালো ভিত্তি দিয়েছে। অথচ টেকসই গণতন্ত্রের জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের কোন বিকল্প নেই। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই কোন স্তম্ভকে দুর্বল রেখে রাষ্ট্র কোনভাবেই সফল ও সার্থক হবে না; শেষ হবে না গণতন্ত্রের আহাজারি-আর্তনাদও।

https://dailysangram.com/post/445448