২ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ১০:১৬

চালের দাম বাড়ছেই

শুল্ক কমানোর সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা : ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের পোয়াবারো

চালের দাম বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। তাদের দাবির মুখে সরকার আমদানি শুল্ক অনেক কমালেও চালের দাম কমছে না। উল্টো নানান কারসাজির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়িয়েই চলেছে। চাল আমদানির জন্য শুল্ক কমানোর সুবিধা সাধারণ ভোক্তা বা ক্রেতারা পাচ্ছে না। বরং ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট শুল্ক ছাড়ের সুফল এবং মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা দু’টোই ভোগ করছে। অর্থাৎ তারা গাছেরটাও খাচ্ছে তলারটাও কুড়াচ্ছে। শুধু তাই নয় ব্যবসায়ীরা এখন চালের আমদানি শুল্ক শূন্য করারও দাবি করছে।

বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য গত ১৫ ফেব্রয়ারি বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৩২০ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। প্রথমে চাল আমদানির শুল্ক ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার। পরে তা আরো কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। বাসমতি ও অটোমেটিক চাল বাদে সব ধরনের চাল আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে গত ১৭ জানুয়ারি সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

এত সুবিধা দেয়ার পরও অনেক ব্যবসায়ী নির্দিষ্ট সময়ে চাল আমদানি না করে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধি করছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে সরকার অনেকের আমদানির অনুমোদন বাতিল করেছে। তবে তাতেও লাভ হচ্ছে না। চালের দাম ৭০ টাকা কেজিতে পৌঁছে গেছে। দুই দফা সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ বেসরকারিভাবে আমদানির জন্য বরাদ্দ দেয়া সব চাল আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে আনতে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। আমদানিকারকদের এই সময় বেঁধে দিয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে ববসায়িরা অর্থাৎ আমদানিকারকরা সরকারের এসব নির্দেশকে খুব একটা আমলে নিচ্ছে না। তারা তাদের মতো করেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, চালের দাম এখনো না কমায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন চাল ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকেরা। আবার তাঁদেরই চাল আমদানির অনুমতি বেশি দেয়া হয়েছে। তারা দ্রুত চাল আমদানি করলে দাম কমে যেতে পারে, এ কৌশল নিয়ে ধীরগতিতে আমদানি করছে। এতে বাজারে ঘাটতি তৈরি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাই সরকারকে যে কোনো উপায়ে বাজারে চালের সরবরাহ বৃদ্ধির দ্রæত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

জানুয়ারিতে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দিয়ে সরকার যখন আমদানি শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়, সে সময় রাজধানীর বাজারগুলোতে খুচরা পর্যায়ে নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৪ টাকা কেজি। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চালের কেজি ছিল ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা। মোটা চাল ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা।

সরকার আমদানি শুল্ক কমানোর পর প্রায় দুই মাসের মতো সময় কেটে গেলেও তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বাজারে। উল্টো গত এক সপ্তাহে চালের দাম নতুন করে আরো বেড়েছে। এখন খুচরা পর্যায়ে নাজিরশাইল ও মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৪ থেকে ৭০ টাকা। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চালের কেজি ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। গরিবের মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকা কেজি।

গত এক সপ্তাহে চালের দাম বাড়ার তথ্য উঠে এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বংলাদেশ’র (টিসিবি) প্রতিবেদনেও। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে মিনিকেট ও নাজির বা সরু চালের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। চালের দামের বিষয়ে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ব্যবসায়ী মো. কবির মিয়া বলেন, গত এক মাসে কোনো ধরনের চালের দাম কমেনি। বরং সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বাজারে এখন ৫০ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। চালের দাম বাড়ায় আমাদের বিক্রি কমে গেছে। মোটা চালের ক্রেতা নেই বললেই চলে। বাজারে দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ ওএমএস’র চাল কিনছেন।

চালের দাম নিয়ে একই ধরনের তথ্য দেন খিলগাঁও রেলগেটের চাল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিনা। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে রশিদের ২৫ কেজির বস্তা ১ হাজার ৫৫০ থেকে ১ হাজার ৫৮০ টাকা বিক্রি করেছি। কিন্তু দাম বাড়ায় এক সপ্তাহ ধরে সেই চাল ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৬২৫ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। তিনি বলেন, চাল আমদানি করার ক্ষেত্রে সরকার শুল্ক ছাড় দিলেও আমদানির চাল এখনো বাজারে এসে পৌঁছায়নি। আমদানির চাল এলে হয়তো চালের দাম কিছুটা কমবে। সহসা আমদানি করা চাল না এলে বৈশাখের আগে চালের দাম কমার সম্ভাবনা কম।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শর্তে গত ৫ জানুয়ারি বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৩২০ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। চাল আমদানির শর্তে বলা হয়, বরাদ্দপত্র ইস্যুর সাত দিনের মধ্যে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে। এ সংক্রান্ত তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে ই-মেইলে জানাতে হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা এক থেকে পাঁচ হাজার টন বরাদ্দ পেয়েছেন, তাদের এলসি খোলার ১০ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ২০ দিনের মধ্যে বাকি চাল বাজারজাত করতে হবে।

এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান পাঁচ হাজার টনের চেয়ে বেশি চাল আমদানির বরাদ্দ পেয়েছে তাদের এলসি খোলার ১৫ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ৩০ দিনের মধ্যে বাকি ৫০ শতাংশ চাল এনে বাজারজাত করতে হবে বলে শর্ত দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু আমদানির অনুমোদন নিয়েও অনেকে সময় মতো চাল আমদানি করছে না। এতে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি সৃষ্টি করে চালের মূল্য বৃদ্ধি করছে। সরকার ব্যবসায়িদের এই সুক্ষ কৌশল বুঝতে পেরে অনেকের অনুমতিপত্র বাতিল করেছে। চাল আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যারা ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট-এলসি) খুলতে পারেনি, ইতোমধ্যে তাদের বরাদ্দপত্র বাতিল করা হয়েছে।

চালের দামের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠাকুরগাঁওয়ের ন্যাশনাল রাইসমিলের মালিক মোহাম্মদ হাসান রাজু বলেন, সরকার চালের দাম কমানোর ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক। কিন্তু চালের দাম কমাতে হলে শুধু শুল্ক কমালেই হবে না, ভোক্তাদের স্বার্থে কিছু সময়ের জন্য আমদানি শুল্ক শূন্য করতে হবে। সরকার ছাড় দেয়ার পর এখনো চাল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এই শুল্ক দিয়ে চাল আমদানি করে দাম কমানো যাবে না। চাল আমদানি করতে গিয়ে আমদানিকারকদের অনেকগুলো কাজ করতে হয়। দুই দেশের (বাংলাদেশ ও যে দেশ থেকে আমদানি করা হয়) বিভিন্ন নিয়ম প্রতিপালন করে চাল আমদানি করতে হয়। সরকারের আমদানিকারকদের অসুবিধাগুলো শোনা উচিত।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, কম দামে চাল আমদানি করতে না পারলে কীভাবে কম দামে বিক্রি হবে। ভারত থেকে চাল আমদানি করতে প্রতি কেজি ৪৪ টাকা পড়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের দেশের চাল নেই। বেশিরভাগই আমদানি করা চাল। তিনি বলেন, চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে অনেককে। তাদের অর্ধেকই চাল আমদানি করেনি। সরকার চাল আনার ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দিলে লাভ কি হবে? কেউ যদি আমদানি না করে, তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

https://www.dailyinqilab.com/article/361931