২ মার্চ ২০২১, মঙ্গলবার, ৯:৫৫

স্বল্পোন্নয়ন থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণ : এক রাজার গল্প

সম্প্রতি জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি তার ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় এই মর্মে সুপারিশ করেছে যে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। এর ফলে পাঁচ বছর প্রস্তুতিকালীন সময় কাটানোর পর ২০২৬ সালে দেশটি স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনৈতিক বিভাগ কর্তৃক তৈরিকৃত ‘বাংলাদেশ প্রেক্ষিত : পরিকল্পনা ২০২১-৪১’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশের মোট রফতানি বার্ষিক ১১ শতাংশ হারে কমতে পারে। এতে প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৫১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতার পর তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে চিহ্নিত একটি রাষ্ট্র ৫০ বছরের মধ্যে সেই অপবাদ ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে এটি একটি বড় অর্জন। এর ফলে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং মানুষের আয় বাড়বে; সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। এর ফলে বিভিন্ন খাতে সরকারের বিনিয়োগও বাড়বে। উন্নয়নশীলে উত্তরণের ফলে ঝুঁকির পরিমাণ কমে যাবে। এতে করে বাণিজ্যিক ঋণে সুদের হার কমবে। বেসরকারি খাতে অর্থায়ন সুবিধা বাড়বে। এভাবে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ সুবিধা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকের আরও উন্নতি ঘটবে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সরকারের আমদানি-রফতানি নীতিতে পরিবর্তন আসবে। কলকারখানার শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে দেশের সমৃদ্ধি বাড়বে। এটা হচ্ছে আশাবাদীদের কথা।

নৈরাশ্যবাদী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশ ভারত ও চীন ছাড়া অন্যান্য উন্নত দেশগুলো থেকে যেসব বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য বিরাট ধাক্কার সম্মুখীন হবে। বলাবাহুল্য, এলডিসি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশ মেধাস্বত্ব, প্যাটেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি ও সেবা খাতে যে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে তা আর পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ওষুধ শিল্প খাতে প্যাটেন্ট লাইসেন্স ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। উন্নয়নশীলে উত্তরণের পর বিনা মূল্যে প্রযুক্তি ও সেবা কিংবা বিশেষ সুবিধা তারা পাবে না। বর্তমানে সহজ শর্তে তারা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে যে অনুদান ও ঋণ সুবিধা পাচ্ছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে। জলবায়ু তহবিল থেকে যে বিশেষ বরাদ্দ পাচ্ছে তাও আর পাওয়া যাবে না। এর ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য বৃদ্ধির যে আঘাত আসবে তা সহ্য করা জনগণের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হলে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ প্রযুক্তির আধুনিকায়নের প্রতি সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও করভিত্তি সম্প্রসারণের অনুকূল নয়, মানুষের পারিবারিক জীবনযাত্রা এতই ভঙ্গুর যে দ্রব্যমূল্যের সামান্য বৃদ্ধি তাদের জীবনযাত্রাকে সহজেই কাবু করে ফেলে। কৃষি এখনও ভর্তুকি নির্ভর। করোনার প্রভাবে ছোট-বড় সকল শিল্প-কারখানা এবং অনানুষ্ঠানিক খাত বিধ্বস্ত; এখনো তাদের পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের ফলে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়ার ক্ষেত্রে যদি বিধিনিষেধ আসে তা হলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মনে করেন যে, বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের প্রচেষ্টা যতটুকু অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক; এখানে সরকার তার সাফল্য দেখানোর জন্য National Accounts এর পরিসংখ্যান পরিবর্তন ও তথ্যের হেরফের করে সূচকের ক্ষেত্রে মেকি অগ্রগতি দেখিয়ে যোগ্যতার মাপকাঠিতে আসার চেষ্টা করেছেন। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের শতকরা ৪১ ভাগ লোক এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী এদের শতকরা ৯০ ভাগ লোক চরম দরিদ্র, তাদের মাসিক আয় ২০০০/- টাকার নিচে অর্থাৎ ২৩.৮০ ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী দৈনিক ১.২৫ ডলারের নিচে আয় সম্পন্ন ব্যক্তিরা হচ্ছে চরম দরিদ্র। এই চরম দরিদ্রদের শতকরা ৪৫ ভাগ দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে, ৩৬ ভাগ হাওড় এলাকায় এবং ৩০ ভাগ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। আবার ৯০ ভাগ পরিবারের উপার্জনশীল সদস্য মাত্র একজন। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ১০ লক্ষ চরম দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্র্যসীমা থেকে তুলে আনার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, পিকেএসএফ ছাড়াও আরডিআরএস, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, রিআরডিআর, ব্র্যাক, প্রশিকা, গ্রামীণ ব্যাংক প্রভৃতিসহ সরকারি বেসরকারি বহু সংস্থা এই কাজে নিয়োজিত রয়েছে। সন্দেহ নেই তাদের প্রচেষ্টায় দারিদ্র্যবিমোচন খাতে বাংলাদেশে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তবে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণের তুলনায় তা নিত্যন্তই নগণ্য। পাশাপাশি ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে। দেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঘুষ, দুর্নীতিতে বিদেশে অর্থপাচার বাবদ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এই অর্থ যদি জিডিপি থেকে বাদ দেয়া হয় তাহলে জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পাবে।

শেষ করার আগে বলে রাখি যে, অর্থনীতিতে আশাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, প্রবৃদ্ধির কোন সীমা নেই। প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে না। খনিজ সম্পদের অপ্রতুলতার ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাবে না। আমাদের সরকার আশাবাদীদের উপর বিশ্বাস রেখেই এগিয়ে চলছেন, তবে অনেক হতাশাবাদী আছেন যারা অর্থনীতিকে হতাশাবাদী বিজ্ঞান বা Dismal Science হিসেবে মনে করেন। তাদের লেখা পড়লে পুরোনো দিনের একটি গল্প মনে পড়ে। এক দেশে ছিলেন এক রাজা, দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিলে তিনি মন্ত্রীদের অর্থনীতিবিদদের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দেন। পরামর্শ শেষ হলে রাজা মন্ত্রীর কাছে অর্থনীতিবিদদের সুপারিশ জানতে চান। মন্ত্রী বললেন, “হুজুর অর্থনীতিবিদরা দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। একদল আশাবাদী আরেকদল নৈরাশ্যবাদী।” রাজা বল্লেন, “নৈরাশ্যবাদীদের বাদ দিন, আশাবাদীরা কি বলে বলুন।” মন্ত্রী বললেন, “আশাবাদীরা বলছেন আগামী বছর দেশের সবাইকে ঘাস খেয়ে থাকতে হবে।” অবাক হয়ে রাজা বললেন, “তবে নৈরাশ্যবাদীরা কি বলছে বলুন। মন্ত্রী বললেন, “নৈরাশ্যবাদীরা বলছে, আগামী বছর সবার জন্য যথেষ্ট ঘাসও পাওয়া যাবে না।” অনেকে মনে করেন আজকের বাংলাদেশের অনেক আশাবাদী অর্থনীতিবিদই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের অনেকাংশই উপলব্ধি করতে পারছেন না।

 

https://dailysangram.com/post/445389