১ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১:৩৯

রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প

সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের গ্রাহকরা নানা ভোগান্তি ও হয়রানিতে পড়েছেন। চুক্তি মোতাবেক টাকা নিলেও সেবাগুলো নিশ্চিত করেনি। গ্রাহকদের পক্ষ থেকে লিখিত ও মৌখিকভাবে দাবি জানালেও তারা এসব আমলে নিচ্ছে না। উপরন্তু গ্রাহকদের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করছেন।


রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী তাদের সব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হলেও গ্রাহকরা অহেতুক দাবি করছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভুলের কারণেও নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে সমালোচনার সারির লোকের সংখ্যা কম। মানসম্মত ফ্ল্যাট পেয়ে বেশির ভাগ গ্রাহকই খুশি।

ভুক্তভোগীরা জানান, রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের যে কটা ভবনের কাজ শেষ করেছে, বাইরে থেকে এসব পরিপাটি দেখা যায়। বাহ্যত দৃষ্টিনন্দন এ ভবনগুলোর ভেতরের অবস্থা পুরোপুরি বিপরীত। অ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের কষ্টের শেষ নেই। সার্ভিস চার্জের নামে বাড়তি টাকা আদায় করছেন কেউ কেউ। অনেক ভবনে সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে। তাদের কথা না শুনলে মারধর, অপমান, লাঞ্ছনারও শিকার হচ্ছেন অনেক সময়। যারা ফ্ল্যাটে উঠেছেন, এসব কারণে মানসম্মানের ভয়ে অনেকে ফ্ল্যাট বেচে দেওয়ার চিন্তা করছেন। তারা আরও জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাজউকের ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। উত্তরার মনোরম পরিবেশে বসবাস করবেন-সেই স্বপ্ন-সাধ একেবারে উবে গেছে। রাজউকও এ ব্যাপারে উদাসীন।

তাদেরকে এসব বলে কোনো লাভ হচ্ছে না। এখানে যার ক্ষমতা আছে, তার কথামতোই অন্যদের চলতে হচ্ছে। স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। আর রাজউকের কাজের মানও হয়েছে নিম্নমানের। সে কারণেও সবাই হতাশ। কিন্তু এসবে রাজউকের কোনো মাথাব্যথা নেই। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ১২ নম্বর ভবন (দোলনচাপা) ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান যুগান্তরকে বলেন, রাজউকের এ প্রকল্পে আমরা ৮০-৯০ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি। চুক্তি মোতাবেক রাজউক আমাদের কাছ থেকে পুরো টাকাই নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এখনো সবকিছু বুঝিয়ে দেয়নি। তিনি বলেন, গ্যারেজ বাবদ আমাদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে অর্থ আদায় করেছে রাজউক। কিন্তু এখনো আমরা জানি না, কোথায় গ্যারেজ হবে। এছাড়া নির্মাণকাজ যে নিম্নমানের হয়েছে, সেটা যত দিন যাচ্ছে, ততই পরিষ্কার হচ্ছে। আমাদের ভবনের লিফটটি শুরু থেকেই সমস্যা। বারবার জানানো হলেও রাজউক এ সমস্যার সমাধানে কোনো প্রতিকার করছে না। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের ফ্ল্যাটের সমস্যার বিষয়টি লিখিত ও মৌখিকভাবে রাজউক চেয়ারম্যান, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়েছি। কিন্তু এ সমস্যার সমাধানে কার্যকর কোনো তৎপরতা লক্ষ করছি না। কয়েকজন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জানান, ফ্ল্যাটের যেসব দরজার চৌকাঠ-পালা দেওয়ার কথা সেগুন কাঠের, সেখানে ব্যবহার হয়েছে গামারি, পাইউড বা প্লাস্টিকের দরজা-চৌকাঠ। উন্নত ফিটিংসের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে অতি সাধারণমানের ফিটিংস। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। টাইলস দেওয়া হয়েছে অতি সাধারণ। লিফটের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। ভেতরের রংও সাদামাটা। গ্যাস সংযোগের জন্য টাকা নেওয়া হয়েছিল, সেটা দেওয়া হয়নি। তারা জানান, যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, এগুলো বেশিদিন টিকবে না। অনেক জিনিসপত্র ভেঙে যাচ্ছে। রাজউক ফ্ল্যাটপ্রতি ইউটিলিটি ফি (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ) বাবদ নিয়েছে ২ লাখ টাকা। কিন্তু এখন সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাও সেটা বসাতে হচ্ছে রান্নাঘরে। কাছে কোনো বাজার নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। রাতে বাইরে যেতে ভয় করে। অনেকটা অরিক্ষত অবস্থা।

তারা আরও জানান, প্রধান দরজা ও চৌকাঠে এমন গাঢ় রং ব্যবহার করা হয়েছে বোঝার উপায় নেই সেটা কী কাঠ। অনেকেই মেহগনি বা গামারি হিসাবে ধারণা করছেন। বারান্দার দরজাগুলোর ফিটিং হয়েছে দুর্বল। অনেক স্থানে ফাঁকা হয়ে আছে। টয়লেটে সাধারণমানের প্লাস্টিক ডোর। দরজার সিটকিনিগুলোও খুবই দুর্বল। দুই ফুট বাই দুই ফুট আকারের টাইলস ব্যবহার করা হলেও রং ও মান দুর্বল। বিদ্যুতের সুইচবোর্ড, ফ্যানের রেগুলেটর, কলিং বেলের সুইচ, জানালায় ব্যবহৃত কাচ, পর্দা ফিটিংস একেবারেই সাধারণ। সিঁড়ির রেলিংয়ের অনেক স্থানেই মরিচা ধরে গেছে।

প্রসঙ্গত, উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে গড়ে ওঠা রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ৬ হাজার ৬৩৬ ফ্ল্যাটের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার ফ্ল্যাট ইতোমধ্যে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজারখানেক বাসিন্দা ইতোমধ্যে উঠেও গেছেন। ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমাট বাঁধছে। যে কোনো সময় এসব গ্রাহক সম্মিলিতভাবে রাজউকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আন্দোলনে যেতে পারেন। রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. মুজাফফর উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পটি নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এখানে দেশীয় মালামাল ও উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণকাজের অনুমোদিত সব উপকরণ ও কাজ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হয়েছে, এটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী তাদের সব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হলেও গ্রাহকরা অহেতুক দাবি করছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভুলের কারণেও নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তবে সমালোচনার সারির লোকের সংখ্যা কম। মানসম্মত ফ্ল্যাট পেয়ে বেশির ভাগ গ্রাহকই খুশি। তিনি বলেন, এ প্রকল্পে অনেক গ্রাহক ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েছেন। এর আগে যারা গুলশান-বনানীতে থেকেছেন, তারা সেখানে নিজেদের মতো করে বিদেশি উপকরণ ব্যবহার করেছেন। সরকারি প্রকল্পে তো সেটা করা সম্ভব নয়। সরকারি অনুমোদিত মান মেনটেইন করা হয়েছে এবং সেই মানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/city/397589