১ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১:৩২

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগে চারদিকে উদ্বেগ

ইবরাহীম খলিল : মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা এবং ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হবে শুরু থেকেই নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন সংগঠন এই আশঙ্কার কথা বলে আসছিল। বাস্তবেও দেখা গেছে বিগত দিনগুলোই। এই আইনের অপপ্রয়োগে অন্তহীন হয়রাণির শিকার হচ্ছেন মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে আইনটির অপপ্রয়োগে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানত বেছে নেওয়া হয়েছে মুক্তমনা লেখক, সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচনাকারীদের। বিশেষ করে ভিন্ন মতের মানুষকে শায়েস্তা করার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া এই আইনের অপপ্রয়োগ ভাবিয়ে তুলছে সচেতন মহলকে। আর এই আইনে ৯ মাস আগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর বিষয়টি আবারও জোরালোভাবে আলোচনায় এসেছে। হয়রানি-নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে ওঠার এই আইন সংশোধনের দাবি বারবার উঠলেও এখন পর্যন্ত সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। উল্টো কথিত ষড়যন্ত্র, ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তৎপরতার অভিযোগ তুলে এই আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে।

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ করে আসছে বিভিন্ন পেশাজীবীও ছাত্র সংগঠনগুলো। উদ্বেগ জানিয়েছেন বিদেশী কূটনীতিকরাও। তারা বলছেন হয়রানিমূলক এই আইন এখনি বাতিল করতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,গত বছরের মে মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে র‌্যাব।

অবশ্য সরকারের একজন মন্ত্রী আইনটি পর্যালোচনা করে সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছেন। শনিবার মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, আলোচনা করে আইনের অনাকাঙ্খিত ধারাগুলো সংশোধন করা সম্ভব। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নিয়ে আয়োজিত ভার্চুয়াল সেমিনারে অংশ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, কোন আইনই সম্পূর্ণ নয়, নয় বিতর্কের উর্ধ্বে । আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমনি আছে তেমনি আছে অপ্রয়োগ। আর তাই প্রয়োজনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির প্রয়োজনীয় সংশোধন করে সংস্কার করা যেতে পারে।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুযারি পর্যন্ত সারাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ৭৮৩টি মামলা দায়ের হয়েছে।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, আইনটির অধিকাংশ ধারায় জামিন অযোগ্যতা, পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশের তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের ক্ষমতা থাকাকেএ আইনের দুর্বলতা । জনগণের মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা সুরক্ষায় সরকাররে দ্রুত আইনের এ ৪টি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বিদেশী কূটনীতিকরাও। এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ১৩টি কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাসমূহ ও তার বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ও মানের সঙ্গে এর সঙ্গতি বিধান নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।

বিবৃতিদাতারা হলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার, ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট ডিকসন, কানাডীয় হাই কমিশনার বেনোয়া প্রিফঁতেন, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি এস্ট্রাপ পিটারসেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজি টিরিংক, ফরাসি রাষ্ট্রদূত জ্যাঁ মারিও সুশো, জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফারেনহল্টৎস, ইতালির রাষ্ট্রদূত ইতালির নতুন রাষ্ট্রদূত এনরিকো নানজিয়াতা, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারউইজ, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার ভেন্ডসেন, স্পেনের রাষ্ট্রদূত ফ্যান্সিসকো দে এসিস বেনিতেজ, সুইডিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেসান্দ্রা বের্গ ফন লিনডে এবং সুইস রাষ্ট্রদূত নাতালি শিয়ার।

আইনটিতে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে দোষী ব্যক্তির ৩ থেকে ৭ বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। আর একই ব্যক্তি এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে তার সাজার পরিমাণ বেড়ে হবে ১০ বছরের কারাদণ্ড।

এ আইনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো বসে বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই বিচার করা যাবে। আইনটির পাসের ২১, ২৫, ২৮ ও ৩৫ ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহারের আশঙ্কা করে সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছেন গণমাধ্যম কর্মী ও সুশীল সমাজ। তারা এ ৪টি ধারাকে বাক-স্বাধীনতা আর মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করে চাইছেন সংশোধন।

https://dailysangram.com/post/445297