১ মার্চ ২০২১, সোমবার, ১:৩১

দুর্নীতি আর মাথাভারি প্রশাসনে ডুবছে চিনি শিল্প

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : বছরের পর বছর লোকসান গুণছে চিনিকলগুলো। লোকসান কমাতে চলতি আখ মাড়াই মৌসুমে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। আপাতত তাদের বেতন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন-বিএসএফআইসি। পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ও ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ থাকলেও কর্মীদের কাউকে ছাঁটাই করা হবে না বলে আশ্বস্ত করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনিকলগুলো বন্ধের অন্যতম কারণ হলো আঁখ চাষ কম হওয়া। আখ চাষিদের অসহযোগিতার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিনিকলগুলো বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ ঘোষণা করে সরকার বাকিগুলোও বন্ধের আয়োজনের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসাবেই ৬টি চিনিকল বন্ধ করা হয়েছে। তারা বলছেন, দুর্নীতি আর মাথাভারি প্রশাসনের চাপে ডুবছে চিনি শিল্প।

জানা গেছে, লোকসান কমাতে চলতি মাড়াই মওসুমে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই খবরে ওই সব কারখানার শ্রমিক-কর্মকর্তাদের মধ্যে চাকরিচ্যুতির আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে আপাতত তাদের বেতন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন-বিএসএফআইসি। গত বছরের ডিসেম্বরে শুরুতে নেয়া এই সিদ্ধান্তের চিঠি সংশ্লিষ্ট মিলগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পৌঁছে গেছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পাবনা সুগার মিল, শ্যামপুর সুগারমিল, পঞ্চগড় সুগার মিল, সেতাবগঞ্জ সুগারমিল, রংপুর সুগার মিল ও কুষ্টিয়া সুগার মিলে উৎপাদন কাজ বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছিলেন বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান সনৎ কুমার সাহা। তিনি বলেন, চিনিকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ দিন ধরে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই ‘সংস্কার ও আধুনিকায়নের’ উদ্দেশেই কারখানাগুলো আপাতত বন্ধ করা হয়েছে। তবে কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে চিঠিতে চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তাতে সংস্কার কিংবা আধুনিকায়নের কথা বলা হয়নি।

এরপর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বস্ত করা হয় ছয়টিতে আখ মাড়াই বন্ধ থাকলেও কর্মীদের কাউকে ছাঁটাই করা হবে না। বলা হয়, ১৫টি চিনিকলের মধ্যে নয়টিতে চলতি মৌসুমে আখ মাড়াই করার সিদ্ধান্ত হয়। বাকি ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই না হলেও সেসব মিলের ক্যাচমেন্ট এলাকায় উৎপাদিত এবং কৃষকের সরবরাহ করা আখ কেনা হবে। চিনিকলের কোনো কর্মকর্তা, কর্মচারী বা শ্রমিককে ছাঁটাই করা হবে না, বরং সমন্বয় করা হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। ১৫টি চিনিকলের মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, ফরিদপুর চিনিকল, রাজশাহী চিনিকল, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড, নাটোর সুগার মিলস লিমিটেড, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লিমিটেড, জয়পুরহাট চিনিকল ও জিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেডে এ মৌসুমে আখ মাড়াই হয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক উপস্থাপিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অধিক লোকবল, মেশিনের দক্ষতা নষ্ট হওয়া, কাচামালের ঘাটতি, দীর্ঘ দিন জমতে থাকা ব্যাংক ঋণের সুদ ও বছরের প্রায় ১০ মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে প্রতি বছরই প্রায় হাজার কোটি টাকা লোকসান গুণছে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকল। ধারবাহিকভাবে চিনিকলগুলো লোকসান করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) গত পাঁচ বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুণেছে। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৮৬ কোটি ২ লাখ টাকা। লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৯৩৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সুগার মিলস্ করপোরেশনকে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনে পরিণত করা হয়। চিনি উৎপাদন বাড়ানো এবং উপজাতভিত্তিক পণ্য উৎপাদন এই করপোরেশনের লক্ষ্য। এই করপোরেশনের অধীনে ১৫টি চিনিকল পরিচালিত হয়।

বিএসএফআইসি ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ৫২৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৬৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৮৩৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এক হাজার ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৯৩৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বর্তমানে দায় দেনার পরিমাণ আট হাজার ৮৪৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। দায়-দেনার মধ্যে ব্যাংক ঋণ সাত হাজার ১৯৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ডিএসএল ও পাকিস্তানি ঋণ ৯৬৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, আখের দাম ৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, বেতন বাকি ৯২ কোটি ৩ লাখ টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ড খাতে ১০৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা, গ্র্যাচুইটি ২৫৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা, সরকরাহকারীদের পাওনা ১৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, আয়কর বাবদ ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, ভ্যাট ৯ কোটি টাকা, ডিলার জামানত ৩৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে বিএসএফআইসির লোকসানের আটটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- চিনির উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রয় মূল্য কম হওয়া, বিশ্বব্যাপী চিনির দাম কমে যাওয়া, পুঞ্জীভূত ঋণ ও সুদের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়া, অধিক চিনি সমৃদ্ধ পোকা ও রোগবালাই প্রতিরোধ সক্ষম আখের জাত উদ্ভাবন না হওয়া, কারখানাগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়া, বেসরকারি খাতে আমদানিকৃত ‘র’ সুগার থেকে রিফাইন্ড সুগার উৎপাদন করে কম মূল্যে বাজারজাত হওয়া, ব্যাংক ঋণের সুদ বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং চিনি সংগ্রহের হার কমে যাওয়া।

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি বন্ধ ঘোষণা করে সরকার বাকিগুলোও বন্ধের আয়োজন করেছে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা বলছেন, ছয়টি চিনিকল সরকার ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করেছে। কিন্তু আগামী মৌসুমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সবগুলো চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্ত আয়োজনই সরকার করে চলেছে। কারণ হিসাবে তারা বলেন, প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে পরবর্তী বছরের আখ চাষের জন্য চিনিকল থেকে বীজ, সার, কীটনাশক ও ঋণ দেয়া হয়। এ বছর কোনো চিনিকল থেকেই আখ চাষিদের সেই ঋণ ও প্রণোদনা সরবরাহ করা হয়নি। ফলশ্রুতিতে কৃষকদের মধ্যে আশঙ্কা বিরাজ করায় এ বছর আখ চাষে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। আখের অপর্যাপ্ততার কারণে চিনিকলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে।

জানা গেছে, ১৫টি চিনিকলের মালিকানায় ১৯ হাজার ৯৬ একক জমি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বর্তমানে নয় হাজার ১৬ জন কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে ৭১৪ জন কর্মকর্তা, চার হাজার ৪০১ জন কর্মচারী ও তিন হাজার ৯০১ জন শ্রমিক রয়েছেন। বাম জোট জানায়, এক কেজি আখের উৎপাদন ব্যয় ৬ দশমিক ৬১ টাকা, আর কৃষক সেটা চিনিকলের কাছে বিক্রি করে ৩ দশমিক ৫০ টাকা। সরকার যে চিনিকলের লোকসানের কথা বলে তা কী আদৌ সত্য? আর লোকসান হলেও দায় কার? ১৯৩৩ সালে দিনারপুরের সেতাবগঞ্জ ও গোপালপুর চিনিকল দুটি ব্রিটিশ আমলে একই মালিক স্থাপন করেছিলেন। তখন একজন ব্যবস্থাপকই কারখানা চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। এখন প্রতিটি কারখানায় একজন এমডি, চারজন জিএম, ডজনখানেক ডিজিএমসহ বিশাল মাথাভারি প্রশাসন চাপিয়ে দেয়া হয়েছে চিনিকলগুলোতে। মাসে শ্রমিকদের মজুরি যা দেয়া হয় তার তিন/চারগুণ বেশি বেতন দিতে হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিনিকল রক্ষায় রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল বন্ধ না করে ভুলনীতি ও দুর্নীতি দূর করে আধুনিকায়ন করে কারখানা চালু করতে হবে। লোকসানের জন্য দায়ি নীতি-নির্ধারক, দুর্নীতিবাজ আমলাদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।

এদিকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোতে এক দিকে চিনি জমে আছে, অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন হচ্ছে না, দেনা মেটানো যাচ্ছে না আখচাষিদের। জমে থাকা চিনি বিক্রি করতে পারলে দায়-দেনার অনেকটা মেটানো যেত বলে চিনিকলগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে কলগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে ভারসাম্য রাখতে সরকারের কিছু চিনি মজুদ রাখতেই হয়। এদিকে পাওনার জন্য হা-পিত্যেস করা আখচাষিরা বলছেন, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে পাটের মতোই রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্প ধুঁকছে।
বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান বাদশা জানান, কৃষকদের অন্তত ৩০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে চিনিকলগুলোর কাছে। অথচ সার ওষুধের অভাবে সঠিক পরিচর্যা করে আখ চাষ করতে পারেনি কৃষকরা। তিনি বলেন, দশকের পর দশক ধরে চলে আসা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চিনিকলগুলো এখন হাজার কোটি টাকার দেনার মধ্যে পড়েছে। তাদের অদক্ষতার দায়ভার এসে পড়েছে কৃষকের উপর।

স্বাধীনতার আগে ও পরে সরকারি চিনিকলগুলোই দেশের চাহিদা পূরণ করতো। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এসব চিনিকলের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়নি। আখ চাষ বাড়ানোরও উদ্যোগ ছিল না। বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিপুল উৎপাদন ক্ষমতার মিল চালু হয়েছে। ফলে বাজারে সরকারি চিনিকলের ভূমিকা এখন গৌণ হয়ে গেছে। দুটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর এখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বিএসএফআইসির আওতায় চিনিকল আছে ১৫টি। এসব চিনিকলের তিনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে, নয়টি পাকিস্তান আমলে ও তিনটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। এদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ২ লাখ ১০ হাজার টন। তবে বর্তমানে এক লাখ টনও চিনি কলগুলো থেকে আসছে না; ফলে বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানি করতে হয়। সরকারি হিসাবে দেশে এখন বছরে ১৪ লাখ টন পরিশোধিত চিনির প্রয়োজন হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি চিনিকলে উৎপাদিত হয়েছে মাত্র ৫৮ হাজার টন চিনি। বিপরীতে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে চিনি শিল্প নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এ তসলিম জানান, ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বলা যায়, একটি প্রতিষ্ঠান বছর বছর লোকসান দিলে এমনিতেই তা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে চিনিকল সরকারি, সরকার একে পুরোপুরি ব্যবসা হিসেবে দেখে না। তিনি বলেন, এটা সরকারের বিবেচনার বিষয় যে তারা এসব মিলকে রাখবে, আরও উন্নত করে লাভজনক করার উদ্যোগ নেবে, নাকি বন্ধ করে দেবে। অবশ্যই এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

https://dailysangram.com/post/445282