দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। নানা ধরনের গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এলাকাভিত্তিক ‘গ্যাং কালচার’ চালু করেছে। এর মাধ্যমে তারা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব অপরাধে। রাজধানীতে ৬০ কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে সক্রিয় ৩৪টি।
এরা মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, খুনাখুনি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছে। এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে ঘটছে সহিংসতা। ঝরছে প্রাণ। এদের হাতে প্রতি মাসে ১৫-২০টি খুনের ঘটনা ঘটছে।
জানা গেছে, গ্যাংভুক্ত কিশোরদের কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে, কেউ এখনো পড়ছে। তাদের আড্ডায় রয়েছে রকমফের। এতে যোগ দেয় তরুণ বখাটে, ছিনতাইকারী ও মাদক মামলার আসামিরাও। আড্ডার ছলে গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ছে অনেক কিশোর। ‘বীরত্ব’ দেখাতে তুচ্ছ ঘটনায় খুনাখুনি, প্রকাশ্যে রাস্তায় গুলি করতে তাদের হাত কাঁপছে না। ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাইয়েও তারা বেপরোয়া।
পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কিশোর অপরাধীরা প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটায়। গত ৩ বছরে শুধু র্যাবের হাতেই গ্যাং কালচারের অভিযোগে ৪ শতাধিক কিশোর আটক হয়েছে। তবে আইনি জটিলতার কারণে অভিযান অনেকটা থমকে গেছে।
এদিকে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সম্প্র্রতি হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৩৪৩ কিশোরকে আটক করে। তাদের মধ্যে ৭১ জনের বিরুদ্ধে ডিএমপি অ্যাক্টে মামলা দেওয়া হয়েছে। আর ২৬৯ জনকে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এসব কিশোর হাতিরঝিলে আসা বিনোদনপ্রেমীদের কাউকে উত্ত্যক্ত করত। আবার কাউকে জিম্মি করে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটাত। ৭ ফেব্রুয়ারি শ্যামপুর থানাধীন ফরিদাবাদ গ্লাস ফ্যাক্টরি একতা হাউজিং এলাকা থেকে ৮ কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে অভিভাবকদের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, রাজধানীতে প্রায় ৬০টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ গ্যাংই সক্রিয়। প্রতিটি গ্রুপে কম করে হলেও ১৫ জন সদস্য রয়েছে। ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
১ জানুয়ারি রাজধানীর মহাখালীতে কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে আরিফ হোসেন (১৭) নিহত হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ১৩ ফেব্রুয়ারি মুগদায় একদল কিশোর-তরুণের দ্বন্দ্বের জেরে ছুরিকাঘাতে হাসান মিয়া (১৬) নামে এক কিশোর খুন হয়। সে একটি ছাপাখানায় কাজ করত। সালাম দেওয়া না দেওয়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে তাকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়।
এ ঘটনার পর পুলিশ ৭ কিশোরকে গ্রেফতার করে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে হাসান মিয়াকে খুন করা হয়েছে।
ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, গড়ে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটে। কোনো মাসে বেশি বা কোনো মাসে কম হয়। বার্ষিক গড় থেকে এ
সংখ্যা বলেছি। সম্প্রতি পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, বর্তমানে কিশোর গ্যাং একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই না তারা মাদক নিয়ে নষ্ট হয়ে যাক। বিষয়গুলোর প্রতি পরিবারের সদস্যদের সচেতন হতে হবে। এ দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। কিশোররা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের আচরণে পরিবর্তন ঘটছে।
কিশোর বয়সে একটা হিরোইজম ভাব থাকে। এ হিরোইজমকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। অনেক ক্ষেত্রে ভিনদেশি সংস্কৃতি আয়ত্তে চলে আসায় তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সমাজের শিক্ষক, অভিভাবক, জনপ্রতিনিধি বা যাদের কথা শুনবে, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এ কিশোর গ্যাং কালচার থেকে বিপথগামী কিশোরদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, শুধু আইনের প্রয়োগ করেই কিশোর গ্যাং থামানো যাবে না। এক্ষেত্রে পরিবারকে আরও সোচ্চার হতে হবে। আপনার সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সন্তানকে সময় দেওয়া, তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মায়ের অবস্থান তুলে ধরা। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন খুবই জরুরি। এ বন্ধন যত হালকা হবে, সন্তান তত বাইরের দিকে ছুটবে, বাইরের কলুষিত বিষবাষ্প গ্রহণ করবে। তখন আর তাকে ফেরানোর কোনো রাস্তা থাকবে না।