২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৯:২১

বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকায় অলস টাকার জোয়ারে ভাসছে দেশের ব্যাংকিং খাত

এইচ এম আকতার : বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংক খাত অলস তারল্যের জোয়ারে ভাসছে।। চলতি ফেব্রুয়ারি মাস শেষে এই পরিমাণ প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটিতে পৌঁছাবে। যা দেশের আর্থিক খাতের জন্য বড় বিপদের পূর্বাভাস। ব্যবসায়ীরা বলছেন,বিনিয়োগ না করে শুধু ব্যাংকে টাকা জমা করে লাভ নেই। আগে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে না পারলে দেশের বেকারত্ব বেড়ে যাবে। আর বেকারত্ব বাড়লে দেশে অপরাধও বেড়ে যাবে।

ব্যাংকগুলো একদিকে নতুন বিনিয়োগ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে, অপরদিকে চাহিদা মতো সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডেও বিনিয়োগ করতে পারছে না। এমনকি কলমানি ও অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত হিসেবেও রাখতে পারছে না। আবার এমন পরিস্থিতিতেই ঋণ শোধের জন্য ব্যবসায়ীদের চাপ দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ই চাপের মধ্যে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট মাসের শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল এক লাখ ৬০ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বরের শেষে তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। চলতি ফেব্রুয়ারি মাস শেষে এই পরিমাণ প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটিতে পৌঁছাবে। অর্থাৎ, ব্যাংকের অলস এ তারল্যের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ঋণ নেয়ার মতো পরিস্থিতিতে তারা এখনও আসেননি। ফলে বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঞ্জীভূত এই অর্থ ব্যাংকগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এভাবে তারল্য বেড়ে যাওয়া আর্থিক খাতের জন্য বড় বিপদের পূর্বাভাস। তারা আরও বলেন, অতিরিক্ত তারল্য ধরে রেখে ব্যাংকের পোর্টফোলিও বড় হলেও দুর্বল হচ্ছে ব্যাংকের ভিত। এমন পরিস্থিতিতে তারল্য কমানোর পদ্ধতি ও কৌশল নিরূপণ করা জরুরি। এই পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবসায়ীদের চাপ দেওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন অনেকে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, টাকার সংকট যেমন এক ধরনের বিপদ, অতিরিক্ত তারল্যও সমান বিপদ বয়ে আনে।

অনেকেই বলছেন, ব্যবসায়ীদের চাপ দিয়ে ঋণ পরিশোধে বাধ্য করা হলে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে ব্যবসা করার মতো পরিস্থিতিতে আমরা নেই। যে কারণে ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর উচিত হবে সুদের হার আরও কমিয়ে আনা ও সব ধরনের চার্জ কমিয়ে আনা। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে। ঋণ শোধের জন্য অতিরিক্ত চাপাচাপি না করে, কীভাবে ব্যাংক ও গ্রাহক ভালো থাকবে, কীভাবে ব্যবসা সচল হবে, সেদিকে নজর দিতে হবে। তবে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সরকার যে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছিল, তা পরিশোধে আরও ছয় মাস সময় বাড়ানোর জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তবে অন্যান্য ঋণ পরিশোধের সময়ও বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিনিয়োগ না করে শুধু ব্যাংকে টাকা জমা করে লাভ নেই। আগে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরত দেওয়ার মতো সুযোগ দিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংক বাঁচাতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের মেরে ব্যাংক উল্টো আরও ক্ষতির মুখে পড়বে। আবার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপরে চার্জ আরোপ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। ব্যবসায়ী এই নেতা বলেন, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত চার্জ আরোপও বন্ধ হওয়া দরকার।

এদিকে শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে যারা ঋণ নিয়েছিলেন, তাদের ঋণ পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড ছিল গত ডিসেম্বর পর্যন্ত। এখন তারা ঋণ পরিশোধে আগামী জুন পর্যন্ত সময় পাবেন। বাকি অন্য প্যাকেজগুলো থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার জন্য নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছেন, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতির মুখে থাকা সত্ত্বেও ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, তাতে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে। ব্যবসায়ীরাও বিপদে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোয়ার বইলেও ঋণের চাহিদা নেই। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, নতুন বিনিয়োগ থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছে। প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে কাক্সিক্ষত মাত্রার প্রায় অর্ধেকে। ব্যাংক খাত থেকে ঘোষণা অনুযায়ী ঋণ নিচ্ছে না সরকারও। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাত অলস তারল্যের জোয়ারে ভাসছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৯৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। এই সময়ে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৮৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে।

ব্যাংকের এমডিরা বলছেন, অতিরিক্ত তারল্য নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে অন্তত ৩০টি বেসরকারি ব্যাংক। শুধু তাই নয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বৃত্ত তারল্য খাটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ব্যাংক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের চাপে এখন চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থায় পড়েছে। এতদিন অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করতো সরকারি বিল-বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদহার নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ইল্ডরেট ছিল মাত্র ৪৫ পয়সা। যদিও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদি বিলের ইল্ডরেট ৬ শতাংশের বেশি ছিল। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার কমেছে বন্ডেও।

২ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আর চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহার নেমেছে ১ শতাংশে। এ অবস্থায় সরকারি-বেসরকারি বেশিরভাগ ব্যাংকেরই ট্রেজারি ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে এসেছে বলে জানান এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, করোনাকালে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। কিন্তু অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগ করার মতো কোনও রূপরেখা এ মুহূর্তে নেই। এই পরিস্থিতিতে আমানতের সুদহার কমানোর মাধ্যমে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমানতকারীরা এ মুহূর্তে নামমাত্র সুদ পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

দি সিটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতকে এখন কষ্ট দিচ্ছে। যেভাবে আমানত আসছে, ঠিক সেই তুলনায় নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। তার মতে, নতুন বিনিয়োগের জন্য আমাদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও দেশে এ মুহূর্তে বড় কোনও শিল্প উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভালো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না বলেও জানান তিনি। এমন পরিস্থিতির কারণেই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে।

যদিও এক বছর আগেও তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছিল বেশিরভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। প্রসঙ্গত, বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্যের জোগান দিয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। রেপো, স্পেশাল রেপো ও অ্যাসুরেড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে এ অর্থ দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রণোদনা হিসেবেও প্রায় এক লাখ কোটি টাকার অর্থ জোগান দেওয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোগান দেওয়া এই অর্থও অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতের জন্য মধুর বিড়ম্বনা। বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে কম সুদে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ দেয়ার মধ্য দিয়ে তারল্য কমিয়ে আনা যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের বিনিয়োগ না করতে পারলে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাবে। আর বেকারত্বে সংখ্যা বেড়ে গেলে দেশে অনেক পিছে পড়ে যাবে। একই সাথে হতাশাগ্রস্ত যুব সমাজ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে।

https://dailysangram.com/post/445088