২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শনিবার, ৯:০৬

নদী হচ্ছে প্রকৃতির ফুসফুস

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : কাউকা এক প্রবহমান নদীর নাম। আন্দেজ পর্বতমালায় এর উৎপত্তি। এরপর কলম্বিয়ার উর্বর ভূমির মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে যায় ক্যারিবীয় সাগর অবধি। নদীটি প্রায় এক হাজার সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার দীর্ঘ। এক পর্যায়ে এটি ম্যাগডালেন নামক নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। উল্লেখ্য, কাউকা নদীর দীর্ঘ যাত্রাপথে রয়েছে অনেক হাইড্রোইলেক্ট্রিক বাঁধ। কয়েক বছর আগে কাউকার এক জায়গায় বিরাট এক বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ বাঁধ নির্মাণের সময় বড় একটা ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে কাউকার ভাটিতে আকস্মিক সৃষ্টি হয় বন্যা। এতে ঐ এলাকার হাজার হাজার বাসিন্দা বাড়িঘর ফেলে পালাতে বাধ্য হন। কিন্তু এরপর যা ঘটে তা বেশ নাটকীয়। বহমান দীর্ঘ কাউকা যেন হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই কাউকা এতোটাই শুকিয়ে যায় যে, স্থানীয় হাইড্রোলজিস্টরা এর পানিও মাপতে অক্ষম হয়ে পড়েন। মাত্র সপ্তাহ খানেকের মধ্যে প্রমত্তা কাউকা শুকিয়ে পাথর-কাদায় ভরাট হবার খবরটি সেসময় সম্প্রচার করে বিবিসি।

কাউকার পানি ভিন্নখাতে নিতে প্রথমে তিনটি টানেল তৈরি করা হয়। পরে টানেলের কাছে বিরাট খাদ তৈরি হলে সমস্যা দেখা দেয়। শুরু হয় ভূমিধস। এতে টানেলের মুখ বন্ধ হয়ে পড়ে। ফলে পানির চাপ বাড়তেই থাকে এবং জলাধার পুরোপুরি ভরাট হয়ে যায়। এক পর্যায়ে পানির প্রবল চাপে টানেলের মুখ হঠাৎ খুলে যায়। এর ওপর প্রবল বৃষ্টিপাত হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। পরবর্তীতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলেও পলিভরাট হয়ে নদীটির আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। এরপর পুরো নদীর মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণিও ছটফট করতে করতে মারা যায়। অর্থাৎ পুরো অঞ্চলজুড়ে দেখা দেয় মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। এক সময়ের প্রমত্তা কাউকা নদী পুরোটাই পাথর আর কাদায় ভরে যায়।
সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়াররা হতাশ। শঙ্কিত। কাউকা আর কখনও নাব্য হবে না।

নদী হচ্ছে প্রকৃতির নাসারন্ধ্র। ফুসফুস। মানবদেহের নাসারন্ধ্র কিংবা ফুসফুস মরে গেলে মানুষ যেমন বাঁচে না, তেমনই নদী শুকিয়ে গেলে প্রকৃতিও বিপন্ন হয়ে পড়ে। মরতে বসে। কাউকা নদীর তীরবর্তী মানুষও নিদারুণ সংকটে পড়েন।

প্রবহমান নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মাণ করে স্বাভাবিক জলস্রোত আটকে কিংবা অন্য স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করলে যেকোনও সময় তার জলধারা বিকল্প পথে ধাবিত হয়ে ঘটাতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়। ধ্বংস করতে পারে জনপদের পর জনপদ। এমনকি মানুষের অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপে শুকিয়ে যেতে পারে কাউকার মতো প্রবহমান প্রমত্তা নদীও। উল্লেখ্য, আমাদের নদীসমূহের প্রায় সবগুলোতেই বাঁধ, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে। উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ প্রায় পানিশূন্য হতে বসেছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইতোমধ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পদ্মা, তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ ছোটবড় সবনদী শুকনো মৌসুমে থাকছে প্রায় পানিশূন্য। বর্ষার সময় অধিক বৃষ্টিপাত হলে সমগ্রদেশ যাচ্ছে ভেসে। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। ফসল উৎপাদন হচ্ছে ব্যাহত। গরমকালে বাড়ছে অস্বাভাবিক উষ্ণতা। শীতে হিমাঙ্কের কাছে নেমে আসছে তাপমাত্রাও। তাই মানুষের অসুখবিসুখ যাচ্ছে বেড়ে। গবাদি পশুপাখির জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ছে। কাউকা নদীর তীরবর্তী মানুষের ওপর যে-ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছে, সেরকম কোনও বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদেরও হতে হয় কি না বলা মুশকিল। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক নদ-নদী মরে গেছে। অনেকগুলো মরণাপন্ন।

এবার মার্চে স্বাধীনতাদিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে আসবার কথা। তখন তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তিস্বাক্ষর হবার কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী তা নাকচ করে দিয়েছেন।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি একটি উদ্বেগজনক খবর পাওয়া যায় দিনাজপুর থেকে। শিরোনাম “মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে দিনাজপুর”। এতে বলা হয়, দিনাজপুরে আবারও ‘সূর্যশিশির’ উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিলুপ্তপ্রায় পতঙ্গভুক এ উদ্ভিদটি দেখতে উৎসুক জনতা ভিড় করছে দিনাজপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে। এটিকে বাংলায় বলা হয় সূর্যশিশির। এটি মাংসাশী উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম “দ্রোসেরা রোতুনডিফোলিয়া/ দ্রোসেরা রোতুনডিফোলি”। এটি “কারযোফজল্লালেস” বর্গ এবং “দ্রোসেরাসেয়াই” গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। জন্মায় অম্ল (গ্যাস) বেড়ে যাওয়া মাটিতে শীতপ্রবণ অঞ্চলে। যেমাটিতে জন্ম নেয় সেমাটির পুষ্টিগুণ কম থাকে। মাটির পুষ্টিগুণ ঠিক রাখবার যে ১৬টি খাদ্য উপাদান প্রয়োজন তার মধ্যে ৯টি উপাদানের ঘাটতি আছে দিনাজপুরের মাটিতে। এ কারণেই দিনাজপুরের মাটিতে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ‘সূর্যশিশির’ জন্মাচ্ছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

উদ্ভিদটির রয়েছে ওষধিগুণ, পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ খেলেও উপকারী পোকা বা কীটপতঙ্গ এ উদ্ভিদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। এ কারণে উপকারী পোকা বা কীটপতঙ্গের ক্ষতি করতে পারে না এটি।

গত ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি দিনাজপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে সংরক্ষিত পুকুরপাড়ের পশ্চিম তীরে বিলুপ্তপ্রায় পতঙ্গভুক ‘সূর্যশিশির’ উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া যায়। এটি শনাক্ত করেন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। গত বছর এখানে তিনটি গাছের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু গত ১ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে প্রায় শত ‘সূর্যশিশির’ উদ্ভিদ দেখা গেছে।

দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন জানান, গোলাকার সবুজ থেকে লালচে রঙের থ্যালাসের মতো মাটিতে লেপ্টে থাকা উদ্ভিদটি মাংসাশী উদ্ভিদসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতির। এ উদ্ভিদে রয়েছে ওষুধিগুণ, পোকা-মাকড় কীটপতঙ্গ খেলেও উপকারী পোকা বা কীটপতঙ্গ এ উদ্ভিদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। ফলে এটি উপকারী পোকা বা কীটপতঙ্গের ক্ষতি করতে পারে না। এরা জন্মায় অম্ল (গ্যাস) বেড়ে যাওয়া মাটিতে শীতপ্রবণ এলাকায়। যে মাটিতে সূর্যশিশির জন্ম নেয় সেই মাটির পুষ্টিগুণ কম থাকে, যা মরুকরণের ইঙ্গিত বহন করে।

সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন আরও জানান, ৪-৫ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট গোলাকার থ্যালাসসদৃশ উদ্ভিদটির মধ্য থেকে একটি লাল বর্ণের ২-৩ ইঞ্চি লম্বা পুষ্পমঞ্জরি হয়। সংখ্যায় ১৫-২০টি তিন থেকে চার স্তরের পাতাসদৃশ মাংসল দেহের চারদিকে পিন আকৃতির কাঁটা থাকে। মাংসল দেহের মধ্যভাগ অনেকটা চামচের মতো ঢালু। পাতা থেকে মিউসিলেজ সাবস্টেন্স নামক একপ্রকার এনজাইম বেরোয়। এনজাইমে পোকা পড়লে আঠার মতো আটকে রাখে। শীতের সকালে পড়া শিশিরে চকচক করে উদ্ভিদটি। তাই আকৃষ্ট হয় পোকার দল। পোকামাকড় উদ্ভিদটিতে পড়লে এনজাইমের আঠায় আটকে যায়।

সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার আরও জানান, কয়েক মাস থেকে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা উদ্ভিদটির সংরক্ষণ এবং বিস্তারে গবেষণা চালাচ্ছেন। উদ্ভিদটি এবারই প্রথম নয়, প্রথম ক্যাম্পাসে শনাক্ত হয় ১৯৯৭ সালে। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ রজব আলী মোল্লা এটি শনাক্ত করেন। তবে উপযোগী পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের কারণে উদ্ভিদটি এখন বিলুপ্তপ্রায়।

দিনাজপুরের মাটিতে অম্লের পরিমাণ বাড়বার বিষয়টি নিশ্চিত করেন দিনাজপুর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কৃষিবিদ মামুন আল আহসান চৌধুরী। তিনিও সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ারের তথ্যগুলোই জানান। অর্থাৎ এসিড বা অম্ল ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলে। এতে দিনাজপুর জেলা মরুকরণের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের জীববিজ্ঞান গ্যালারিতে প্রদর্শিত উদ্ভিদটির ছবিতে দেয়া তথ্য অনুসারে বিলুপ্তপ্রায় এটি বাংলাদেশে শুধু দিনাজপুর, রংপুর ও ঢাকা জেলায় পাওয়া যায়।

মরুকরণ প্রক্রিয়া থেকে দেশ বাঁচাতে হলে পৃথিবী ও প্রকৃতির ফুসফুস নদী বাঁচাতেই হবে। নদী না বাঁচলে মানুষ, প্রাণি, উদ্ভিদ, পাহাড় সবই হবে বিপন্ন। মরুভূমিতে পরিণত হবে সমগ্র পৃথিবী। অতএব আসুন নদী কীভাবে বাঁচে তার উপায় বের করি।

https://dailysangram.com/post/445075