২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১২:২৯

ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি

সঠিক পরিসংখ্যান নেই মন্ত্রণালয়ে

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশে গত ২ বছরে প্রায় তিন হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিল করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। জাল-জালিয়াতি ও নিয়মবহির্ভূত গেজেট জারির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সনদ ও গেজেটগুলো বাতিল করা হয়।

এসব সনদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি করছেন অনেকের সন্তান ও নাতি-নাতনিরা। সংশ্লিষ্টদের মতে, সনদ বাতিল হলে এ কোটায় পাওয়া চাকরির কোনো বৈধতাও থাকে না। বাতিল সনদের মাধ্যমে বর্তমানে কতজন সরকারি চাকরি করছেন- এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই জনপ্রশাসন এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে। কাজেই শিগগিরই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চাইবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ যুগান্তরকে বলেন, ‘কারও বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তা মন্ত্রী মহোদয় ব্যক্তিগত শুনানি করেন। প্রয়োজনে তা জামুকায় উপস্থাপন করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে গেজেট ও সনদ বাতিলের সুপারিশ করলে মন্ত্রণালয় তা বাতিল করে থাকে। কিন্তু বাতিল সনদের মাধ্যমে কজন সরকারি চাকরি করছেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। আমরা শুধু বাতিলের গেজেট প্রকাশ করি। সেটি জানার পর কোনো মন্ত্রণালয় বা দফতর সুনির্দিষ্ট কারও বিষয়ে মতামত চেয়ে এখন পর্যন্ত চিঠিপত্র দেয়নি।’

তবে মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখার উপসচিব রথীন্দ্র নাথ দত্ত যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের ২ বছরে (২০১৯ ও ২০২০) প্রায় ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিজিবির ১১৩৪ জন এবং বিমানবাহিনীর ৪৬ জন আছে। সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর খুনি মোসলেহ উদ্দিন খাননহ ৫২ জনের গেজেট বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু বাতিলকৃত গেজেট ও সনদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কতজন সরকারি চাকরি করছেন তার হিসাব আমাদের কাছে নেই।’

বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিলের ক্ষেত্রে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২-এর ৭(ঝ) ধারা প্রয়োগ করা হয়। এতে বলা আছে, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সনদপত্র ও প্রত্যয়নপত্র প্রদানে এবং জাল ও ভুয়া সনদপত্র ও প্রত্যয়নপত্র বাতিলের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ।’ কেউ প্রকৃত তথ্য গোপন করে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিলে যাচাই-বাছাই- এ তা প্রমাণ হলে এ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে যাদের সনদ ও গেজেট বাতিল হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে এটি অর্জন করেছেন ৮-১০ বছর কিংবা তারও আগে। সঙ্গত কারণে এসব সনদ ও গেজেটের ভিত্তিতে সম্মানী ভাতা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা তারা ভোগ করে আসছেন। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের চাকরির বিশেষ সুবিধা ভোগ ছাড়াও তার সন্তান কিংবা নাতি-নাতনিরা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, যার ওপর ভিত্তি করে চাকরি হয়েছে সেটি বাতিল হলে ওই চাকরি না থাকাটাই স্বাভাবিক। এছাড়া যে কোনো চাকরির নিয়োগপত্রে উল্লেখ থাকে, কোনো অসত্য তথ্য দিলে বা কোনো তথ্য গোপন করলে নিয়োগ বাতিল হবে। এমনকি বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে বলা থাকে- ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের সংশ্লিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ পরবর্তীতে যাচাই-বাছাইকালে মিথ্যা বা জাল প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে তার নিয়োগ বাতিল হবে এবং প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে।’

উল্লিখিত বিষয়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বাতিল হওয়া সনদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বর্তমানে কতজন চাকরি করছেন- এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। পিএসসি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুপারিশে আমরা নিয়োগ দেই। মুক্তিযোদ্ধা কোটার চাকরির ক্ষেত্রে সনদ প্রত্যয়ন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারাই গেজেট বাতিল করে। তারা গেজেট-সনদ বাতিল করলেও ওই গেজেট-সনদের মাধ্যমে কেউ সরকারি চাকরিতে আছে কিনা- তা আমাদের জানায় না। সে কারণে এর কোনো পরিসংখ্যানও নেই। শিগগিরই এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হবে।’

জনপ্রশাসন সচিব আরও বলেন, ‘যাদের সনদ বাতিল হলো তাদের কতজনের সন্তান, নাতি-নাতনি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি করছেন সে বিষয়টি সনদ বাতিলকারী কর্তৃপক্ষের (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়) কাছে থাকার কথা। এছাড়া তাদের সম্পর্কে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), জনপ্রশাসন বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো কেস জনপ্রশাসনে আসেনি। তাছাড়া বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত থাকতে হবে।’

বাতিল হওয়া সনদের মাধ্যমে চাকরিজীবীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে নানা আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেন শেখ ইউসুফ হারুন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে নানা প্রশ্ন উঠবে। ভুয়া সনদের মাধ্যমে চাকরি করে অনেকে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র পদে গেছেন। সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। বেতন-ভাতাসহ সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তার কি হবে? এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে অভিযুক্তরা আদালতে যাবেন, শত শত মামলা হবে। এ বিষয়ে করণীয় জানতে চেয়ে পিএসসিতে চিঠি লেখা যেতে পারে।’

বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম-বেশি ২ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪৬ জন। এর মধ্যে বেসামরিক গেজেটে আছে ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি। মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার ভারতের তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তার তালিকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৩১১ জন মাসিক সম্মানী ভাতা নিয়ে থাকেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/397299/