রাজশাহী: বালু পরিবহনের জন্য নদীর বুকে (বামে) ট্রাক চলাচলের রাস্তা করা হয়েছে। (ডানে) চরে করা হয়েছে পুকুর খনন -সংগ্রাম
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১২:২৭

রাজশাহীতে পদ্মার বুকে এখন চাষাবাদ পুকুর ও পরিবহনের রাস্তা

একদা ‘প্রমত্তা’ বলে কথিত পদ্মা নদীর বুকে এখন চলছে দাবিদার আর দখলদারের দাপট। চলছে হালচাষ, পুকুর খনন আর বালু পরিবহনের জন্য ট্রাকের রাস্তা তৈরি। পদ্মার বুকে রাজশাহীর এই চিত্র নদীর সামগ্রিক পরিবেশের জন্য বিপর্যয়কর হয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমনিতেই ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় পদ্মার এখন শীর্ণ দশা চলছে। একারণে নদীর বুকে পড়েছে অসংখ্য চর। শুকনো মৌসুমের শুরু থেকেই এই চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। এর মধ্যে এসব চরগুলোর বিভিন্ন অংশ কেউ প্রভাব খাটিয়ে কেউবা পৈত্রিক সম্পত্তির দাবি নিয়ে দখল করে নানাভাবে কাজে লাগাচ্ছে। ইতিহাস বলে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে জাহাজ নোঙর ফেলতো রাজশাহীর পদ্মার ঘাটে। যার কারণেই নগরীর একটি ঘাটের নাম জাহাজ ঘাট। কিন্তু এখন এসব কেবলই স্মৃতি। রাজশাহীর পদ্মা নদীর গর্ভে এখন অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগেছে। আর এখন তাই রাজশাহীতে শুরু হয়েছে চর দখল।

চরে ফসলের আবাদ: রাজশাহীতে পদ্মার বুকে নানাবিধ ফসলের চাষাবাদে বদলে গেছে প্রাকৃিতক চেহারা। কথা ছিল নদীর বুকে চলবে নৌকা, পরিবহন করা হবে পণ্য, মাছের বিপুল উৎপাদন হবে প্রাকৃতিক আধারে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা হবে এই নদীর মাধ্যমে। ভরা পদ্মার বুক থেকে পানি নিয়ে হবে ফসলের আবাদ। এখন তার উল্টো চিত্র। ধু-ধু বালুচরের পলি মাটিতে পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ, টমেটো, সিম, গাজর, মুলাসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষাবাদে ভরে উঠছে চরের জমি। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নদী খনন এবং ড্রেজিং না করায় দিনের পর দিন পলি মাটিতে ভরে উঠেছে। নদী বর্তমানে প্রায় সমতল ভূমিতে পরিণত হতে চলেছে।

জেলার পবা, গোদাগাড়ী, বাঘা ও চারঘাট উপজেলার বিভিন্ন চরে কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে ফলছে বোর ধান। এছাড়া আরো কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে গম, মসুর, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়াসহ হরেকরকম ফসল। চাষিরা জানান, প্রতি বছরই বাড়ছে চাষের পরিধি। সেই সঙ্গে বাড়ছে ফলন। লাভের টাকা হাতে পেয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক কৃষকরা। জেলা কৃষি অফিস বলছে, গত কয়েক বছর থেকে বালুচরে বিভিন্ন ফসল চাষ হচ্ছে। আগের চেয়ে ফলন আরো বেশি হচ্ছে।

চরে পুকুর খনন: পদ্মার কেবল দখল করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি দাপুটে প্রভাবশালীরা। দখল করা সেই চর খনন করে বানিয়েছে পুকুর। সেই পুকুরে করছে মাছের চাষ। এমনই এক পুকুর খনন করা হয়েছে রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকা সংলগ্ন পদ্মার চরে। অভিনবভাবে চারদিকে পাড় তুলে মাঝ চর বরাবর পুকুরটি কাটা হয়েছে। মানুষের প্রবেশ ঠেকাতে ওই পুকুরের চারপাশে দেয়া হয়েছে বাঁশের বেড়াও। আর পুকুরের মাছ পাহারা দেয়ার জন্য তার পাশেই একটি টিনের ঘরও বানানো হয়েছে। পদ্মা নদীর পানি শুকিয়ে চর পড়লেই তীরবর্তী মানুষ সেখানে তার জমি রয়েছে বলে দাবি করেন। খনন করা ওই পুকুর মালিকদের দাবি, জমিটি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। যে কারণে পানি শুকিয়ে চর পড়ার পর সেখানে তারা পুকুর কেটে মাছ চাষ করেছেন। চরের মধ্যে পুকুরের কারণে একদিকে নদী ও শহরের সৌন্দর্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি নদীরও নদীর ক্ষতি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এলে নদী ভরে উঠবে। তখন এ ধরনের পুকুর খননের কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হবে এতে তীরবর্তী এলাকায় তীব্র ভাঙন দেখা দেবে। আর এতে তীরের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন অনেকেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী বলেন, মূলত পদ্মার পাড়ের নিচ থেকে পুরোটা নদীরই জমি। পাড়ের নিচের জমিগুলো সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। যদি এমনও হয় যে, কারো ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি পদ্মা গর্ভে চলে গেছে। তাহলে সেটি খাস জমি বলেই পরিগণিত হবে। এরপরও কীভাবে পদ্মার জেগে ওঠা চরের জমিতে পুকুর খনন হলো, সেটি তারা খতিয়ে দেখবেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান পাউবোর এই কর্মকর্তা।

পদ্মার বুকে রাস্তা : রাজশাহীতে ইজারার নামে বালু উত্তোলনের কোন নিয়ম-কানুন না মেনে পদ্মার চর থেকে বালু তুলে ট্রাকে পরিবহণের জন্য তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। এভাবেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাত দিন বালু তোলা হচ্ছে। রাজশাহী নগরীর শ্রীরামপুরে একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ছত্রছায়ায় এই কাজ চলছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, এর আগে রাস্তা তৈরি করার সময়ই রাজশাহী জেলা প্রশাসন অভিযান চালায়। আবার ওই পথে বালু আনা-নেয়া হচ্ছে শুনে গত বৃহস্পতিবার প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে রাস্তা কেটে দেয়া হয়। সোমবার স্থানীয় লোকজন জানান, ম্যাজিস্ট্রেট চলে যাওয়ার পরই রাস্তা ঠিক করে আবার বালু পরিবহন শুরু হয়। এর আগে নগরীর তালাইমারী ঘাট থেকে খানিকটা দূরে চরে এরকম বাঁধ দেয়া হলে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তা অপসারিত হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চরেও এরকম রাস্তা তৈরি করে বালু পরিবহণের ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য, দেশে বিদ্যমান পরিবেশ আইন এবং বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এবং বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১১ অনুযায়ী এধরনের কাজ বেআইনি হলেও ক্ষমতা ও প্রভাবের জোরের কাছে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।

https://dailysangram.com/post/445169