২৭ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ২:৩১

সিলেটে কান্না আর্তনাদ, আতঙ্ক

টিভিতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার খেলা চলছিল। প্রথমে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কাকে ৩২৫ রানের টার্গেট ছুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিজয়ের সম্ভাবনায় সারা দেশের মতো সিলেটের দর্শকরাও আনন্দে উদ্বেলিত। তবে তাদের মাঝে কিছুটা উত্তেজনা ছিল শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকে ঘিরে। কি হচ্ছে জানতে খেলার চ্যানেল পাল্টে তারা কিছুক্ষণ পরপরই চোখ রাখছিলেন নিউজ চ্যানেলে। তখনই জানতে পারেন ভয়াবহ সংবাদটি। শিববাড়িতে জঙ্গি আস্তানার কাছে হতাহতের সংবাদ। খেলা থেকে চোখ সরে যায় তাদের। সকলেই খোঁজ নিতে থাকেন জঙ্গি অভিযানের। একে একে শুনতে থাকেন ৬টি মৃত্যুর সংবাদ। জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান দুই পুুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন। ৬ লাশের শোকে ভারি হয়ে উঠে সিলেট। আহত হন র্যাজব-পুলিশের সদস্যসহ আরো অনেকেই। শনিবার সন্ধ্যার বোমা হামলার পর একে একে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হওয়া নামগুলো হচ্ছে সিলেটের কোর্ট ইন্সপেক্টর চৌধুরী আবু কায়সার, জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম, দক্ষিণ সুরমার বাসিন্দা ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, ছাত্রলীগ নেতা ফাহিম আহমদ মাহদী, নগরীর দাঁড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম, অন্য আরেক জনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি কেউ। নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। আর আহতরা কাতরাচ্ছেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কাঁদছেন তাদের স্বজনরাও। বোমা হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন র্যাীবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ও র্যােব-৯ এর মেজর আজাদও। রাতেই লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়।


শোকার্তরা ছুটতে থাকেন ওসমানী হাসপাতালে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি, তবুও ফিরে আসতে চান না তারা। রক্ত দেয়ার জন্য লাইন বেঁধে অপেক্ষা করতে থাকেন। ওসমানীতে সারারাতই চলতে থাকে শোকার্তদের মিছিল। শোকে আচ্ছন্ন সিলেটে রোববার দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় দুই পুলিশ কর্মকর্তার জানাজা। সিলেট পুলিশ লাইন মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শামিল হন। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা সিরাজুল ইসলাম। এর আগে নিহত দুই কর্মকর্তার জন্য অশ্রুসজল কণ্ঠে দোয়া প্রার্থনা করেন নিহত আবু কায়সারের মামা আবদুল করিম চৌধুরী ও মনিরুল ইসলামের ভাই শামীম হোসেন। জানাজা শেষে দুই কর্মকর্তার প্রতি অন্তিম সম্মান জানানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। এরপর কফিনবন্দি করা হয় মরদেহগুলো। কফিনে জুড়ে দেয়া হয় নিহতদের নামলিপি। এরপর আবু কায়সারের মরদেহ নিয়ে পুলিশের গাড়ি ছুটে চলে সুনামগঞ্জের দিকে, আর মনিরুলের মরদেহবাহী পুলিশের গাড়ি ছুটে চলে নোয়াখালীর দিকে যেখানে নিহত দুই কর্মকর্তার স্বজনরা অপেক্ষায় তাদের প্রিয়জনকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য।


জঙ্গি হামলায় নিহত কোর্ট ইন্সপেক্টর চৌধুরী আবু কায়সারের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ছৈলা গ্রামে। মরহুম অ্যাডভোকেট আসদ্দর চৌধুরীর ছেলে আবু কায়সার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষে ১৯৯৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী সায়রা চৌধুরী, কোনো সন্তান নেই তাদের। ৭ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে আবু কায়সার ছিলেন তৃতীয়। অন্যদিকে নোয়াখালী থেকে সিলেটে দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম। নোয়াখালী সদরের পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের চার ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানের মধ্যে মনিরুল দ্বিতীয়। ২০০৩ সালে সাব- ইন্সপেক্টর হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। তার স্ত্রীর নাম পারভীন আক্তার। মোজাক্কেরুল ইসলাম ফারাবি নামে ১৫ মাস বয়সী ১ ছেলে সন্তানও রয়েছে তার।


নিহত ওয়াহিদুল ইসলাম অপু ও ফাহিম আহমদ মাহদী দুজনেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মহানগর ছাত্রলীগ নেতা অপু নগরীর ঝালোপাড়ার মরহুম সিরাজুল ইসলাম আওলাদের একমাত্র ছেলে। নিহত ফাহিম আহমদ মাহদী ছাত্রলীগ দক্ষিণ সুরমা উপজেলা শাখার উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক।


বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িতে জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রেখেছিলো পুলিশ। শুক্রবার পুলিশের সঙ্গে যোগ হয় বিশেষ বাহিনী সোয়াত। পরে আসে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিম। শনিবার সকালে শুরু হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। দিনভর চলে অভিযান, উদ্ধার করা হয় বাড়ির ভেতর আটকে পড়া বাসিন্দাদের। সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালীন সময়েই শনিবার সন্ধ্যায় পার্শ্ববর্তী পাঠানপাড়ায় প্রধান সড়কের পাশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সড়কের ওই স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন ও সাধারণ মানুষকে আটকে দেয়া হয়েছিল। যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। ব্যারিকেডের বাইরে উৎসুক মানুষজনও ভিড় করছিল। তখনই দুটো মোটরসাইকেলে চড়ে আসে তিন জন। তারা জনতার ভিড়ে ঢুকে যাওয়ার পর বিকট শব্দে ঘটে বিস্ফোরণ। সে হামলার শিকার হয়েই একে একে নিহত হন চার জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলটি ঘিরে রাখে। সেখানে তখন পড়েছিলো আরো একটি বোমা, কিছুক্ষণ পরই সেটার বিস্ফোরণ ঘটে। সে বোমার আঘাতেই নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশের ধারণা দ্বিতীয় বোমাটি ছিল টাইম বোমা। নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও একজনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশের ধারণা অজ্ঞাতপরিচয় সে যুবকই হয়তো সেই তিন যুবকের একজন যারা বোমা বয়ে এনেছিলো। আহতদের মধ্যেও হামলাকারীরা থাকতে পারে বলেও ধারণা করছে পুলিশ। তাই আহত সকলেই রয়েছেন পুলিশের নজরদারিতেই।


সিলেট জুড়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক: গোটা সিলেটেই যেন আতঙ্ক নেমে এসেছে। সিলেট নগরীর বাসিন্দারা রীতিমতো আতঙ্কিত। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। এ ঘটনায় আতঙ্কের পাশাপাশি স্তম্ভিতও তারা। সিলেট নগরীর একপাশে শিববাড়ি। পাশেই শিব মন্দির। জনাকীর্ণ এলাকা। আর এই এলাকায় জঙ্গিরা ঘাপটি মেরে আছে এমনটি স্থানীয়রা কল্পনা করতে পারেননি। পাঠানটুলা এলাকার বাসিন্দা স্থানীয় সংবাদকর্মী গোলাম মর্তুজা বাচ্চু এ ঘটনায় হতবাক। তিনি বলেন, এলাকার মানুষ স্তম্ভিত। তারা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি এতো বড় জঙ্গি আস্তানা এই শিববাড়িতে। এই এলাকায় যারা বাসা ভাড়া দেন তারা যেন সব তথ্য রেখে যাচাই-বাছাই করে ভাড়া দেন এ অনুরোধ জানান তিনি। এদিকে শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানায় ছুটে যাচ্ছেন সিলেটের রাজনৈতিক দলের নেতারাও। গত তিন দিনে ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী। তারাও এ ঘটনায় হতবাক। আর গতকাল দুই ইন্সপেক্টর নিহতের ঘটনায় তাদের চোখেও জল। সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান জানিয়েছেন, ‘কী বলবো। এক সঙ্গে ছয় জন মানুষের মৃত্যুতে সিলেটবাসী শোকে শোকাহত। যে দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন তারা আমাদের নিরাপত্তার জন্য মারা গেছেন। তিনি সিলেট নগরবাসীকে ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের অনুরোধ জানান।’ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। আর যাতে পুলিশসহ সাধারণ মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।’ শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানা দেখতে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ দলে দলে এসেছে। কিন্তু জঙ্গি আস্তানার বাইরে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণে আতঙ্ক নেমে এসেছে। এ কারণে ওই আস্তানায় দেখতে গতকাল স্থানীয় লোকজনের সংখ্যা ছিল খুব কম। এখন কোথায় বোমা বিস্ফোরিত হয় সেটি কেউ বলতে পারে না। স্থানীয়রা জানান, শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানায় জঙ্গিদের একটি টিম অবস্থান করছে সেটি তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। মসজিদেও তাদের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়নি। তবে কয়েক দিন ধরে এলাকায় অচেনা-অজানা লোকদের আনাগোনা ছিল বলে জানান তারা। শিববাড়ি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, আতিয়ার মহলের কাছাকাছি তাদের দোকান। ওই মহলে প্রায় ৩০টি পরিবার বসবাস করে। শতাধিক লোকের বাস ওখানে। সুতরাং যারা কয়েক বছর ধরে বাসায় বসবাস করছেন তাদের সঙ্গে সবার পরিচয় আছে। কিন্তু যারা নতুন ভাড়াটিয়া আসেন তাদের অনেককেই তারা চিনেন না। জঙ্গিদের অবস্থান তাদের দৃষ্টিতে পড়েনি। তবে ইদানীং নতুন লোকদের বিচরণ ছিল বেশি। শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানার কথা এখন সিলেটবাসীর মুখে মুখে। সবাই পর্যবেক্ষণ করছেন বিষয়টি। ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। অনেকেই বলছেন, শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানায় অভিযান সিলেটের সবচেয়ে বড় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পরিণত হয়েছে। আগে কখনো এতো বড় জঙ্গি আস্তানার খোঁজ মেলেনি শান্তির জনপদ সিলেটে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=59040&cat=2