২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১:৫১

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা

তড়িঘড়ি করে পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার। আন্দোলনের মুখে গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৭ কলেজের স্থগিত পরীক্ষা পুনরায় চালু করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গতকাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে একটি মহল শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে চাইছে। আন্দোলনের ভয়েই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর।

দেশে গত বছরের মার্চে হানা দেয় করোনাভাইরাস। এর কয়েকদিনের মধ্যেই অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বিভিন্ন সময় বারবার ছুটির সময় বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত বন্ধই রাখা হয়। একপর্যায়ে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা হলে ফেরার অনুমতি পায়নি। করোনা মহামারির কারণে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী, অষ্টমের সমাপনী ছাড়াও এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়। জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলেও প্রাথমিকের অন্যান্য শ্রেণিগুলোয় পরীক্ষা ছাড়া পরবর্তী ক্লাসে তুলে দেয়া হচ্ছে। আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও হল না খোলায় বিপাকে পড়েন তারা। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস খুলে দেয়ার দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীরনগরে স্থানীয়দের সাথে অপ্রীতিকর এক ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে প্রবেশ করে হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কয়েকটি হলে প্রবেশ করে। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। গত সোমবার হঠাৎ করেই শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি চলমান সকল পরীক্ষা বন্ধ ঘোষনা করেন। তিনি ঘোষনা করেন, বন্ধ থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলবে আগামী ২৪ মে। এর আগে ১৭ মে হলগুলো খুলে দেয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং হলে থাকা শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগ পর্যন্ত সব ধরনের পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। তবে অনলাইনে ক্লাস চলবে।

তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেননি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা আরো তিন মাস অপেক্ষা করতে রাজি নন। চলতি মাসেই তাঁরা হলে উঠতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করলেও তাঁরা এখনো দাবিতে অনড় রয়েছেন এবং কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

পরদিন মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সরকারের সিদ্ধান্তের সাথেই একমত প্রকাশ করে পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানান।

ওই দিন রাতেই নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরদিনও তারা অবরোধ করে পরীক্ষা চালু রাখার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। বুধবার সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় জরুরি সভা ডাকলেও পরে দুপুরেই সভা করে ৭ কলেজের পরীক্ষার অনুমতি দেয়।

বৃহস্পতিবার থেকে শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশ প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থীকে আটক করে। তবে সন্ধ্যায় তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।

পুলিশের বাধার মুখে আলটিমেটাম দিয়ে স্থগিতকৃত পরীক্ষা গ্রহণের দাবিতে করা আন্দোলন রোববার পর্যন্ত স্থগিত করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার শাহবাগে পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে কয়েক দফায় পুলিশের বাধা পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে স্থগিতের ঘোষণা দেয় তারা।

গত সোমবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার শাহবাগে এসে জড়ো হতে থাকে। কিন্তু কর্মসূচির শুরুর আগেই ১০ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে শতাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে আন্দোলন করতে চাইলে জাতীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের আটকে দেয়া হয়।

এ দিকে পরীক্ষার দাবিতে সড়ক অবরোধ করা রাজধানীর গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। গতকাল বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেন। পরে দুপুর ১২টায় শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিপেটা করে সড়ক থেকে উঠিয়ে দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থীরা কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছেন। সর্বশেষ বিকেল পাঁচটায়ও এ বিক্ষোভ চলছিল। কলেজটির সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। এ সময় পুলিশদের একটি অংশ তাঁদের মেরে রাস্তা থেকে উঠিয়ে দেয়। তাঁদের সঙ্গে কোনো প্রকার কথা না বলেই হামলা করেছে পুলিশ।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ লালবাগ থানার অধীন। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক ফিরোজের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি লাঠিপেটার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

বৃহস্পতিবার হোম ইকোনমিক্স কলেজের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাফি গণমাধ্যমকে বলেন, পরীক্ষা শুরুর ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমার কলেজ ছাড়ছি না।

কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ইসমাত রুমিনা বলেন, আমাদের কিছু করার নেই। মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিক্ষার্থীরা লিখিত আবেদন দিলে মন্ত্রণালয়ে তা পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী ভ্যাকসিন দেয়ার পর পরীক্ষা শুরু হলে তা শিক্ষার্থীদের জন্য মঙ্গলজনক।

উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক: শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, বিভিন্ন আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে একটি মহল শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে চাইছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় একটি অনুষ্ঠানে শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার কারণে হলগুলোর সংস্কারকাজ এবং শিক্ষার্থীর সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য সময় নেয়া হয়েছে। এসময় শিক্ষার্থীদের সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠক হবে, সেখানে আগামী ১ মার্চ থেকে স্কুল খুলে দেয়া হবে কী না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তিন মাস পরে পরীক্ষা দিলেও সেশনজটে পড়বে না। মানবিক কারণেই সাত কলেজে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। পরীক্ষা না নিলে তারা তিন বছর সেশনজটে পড়ে যাবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষাসহ তিন মাসের সব পরীক্ষা স্থগিত করায় বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের চলমান পরীক্ষা স্থগিত করে দিয়েছে। মহামারীর সময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিভিন্ন পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। আগামী রোববার থেকে স্থগিতাদেশ কার্যকর হবে।

এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দুপুরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে পরীক্ষার দাবিতে শ্লোগান দিতে থাকেন।

এ সময় অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী দেয়ান তাহমিদ বলেন, তেহাত্তরের অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী বলেছে তা দেখার চেয়ে শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের বিষয়গুলো বিবেচনা করে অবিলম্বে চলমান পরীক্ষায় স্থগিতাদেশ বাতিল করতে হবে।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুন সাদিয়া পুষ্প বলেন, আমাদের বয়স তো থেমে নেই, চাকরি কোথায় পাব? পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণার পর মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। শিক্ষার্থী হওয়া তো আমাদের অপরাধ না।

সিলেটে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ: সিলেটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিতে ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরীক্ষা স্থগিতের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। দুপুরে নগরীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনের আয়োজন করে।

মানববন্ধনে উপস্থিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন- সরকার করোনার দোহাই দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে, দেশের অন্যান্য সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রেখে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে।

মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলটি নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে চৌহাট্টা পয়েন্টে এসে শেষ হয়। মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নাজমুস সাকিব, আব্দুল্লাহ আল মামুন সুজন, মোস্তাফিজুর রহমান, আখতার হোসেন, তোফায়েল আহমদ, সায়েম আহমদ, তারেক আহমদ, ওয়াহিদুজ্জামান মাসুদ, ফাহাদ আহমদ, জাহিদ হাসান, জাতীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আশরাফ আহমদ, যুগ্ম আহ্বায়ক জুনায়েদ আহমেদ, রাহুল আহমদ, সাবিনা সেবিন প্রমুখ।

https://dailysangram.com/post/444950