২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, শুক্রবার, ১:৫০

পাপুলের পাপ

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী: বাংলাদেশে বিনাভোটে জালিয়াতির নির্বাচনে সহিদ ইসলাম পাপুল এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। টাকা ছড়িয়েছিলেন শত কোটি। প্রথমেই তিনি লক্ষ্মীপুর দুই আসনে জাতীয় পার্টির এমপি প্রার্থী মোহাম্মদ নোমানকে বার কোটি টাকা দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। নোমান অনন্যোপায় ছিলেন। আওয়ামী লীগের বড় বড় চাঁইয়েরা তাকে চাপ দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। নোমান যদি ঐ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন, তাহলে অবধারিতভাবেই তিনি নির্বাচিত হতেন। কিন্তু পাপুল তা হতে দেননি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম চিঠি লিখে সকলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ঐ আসনে যেহেতু আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী নেই, অতএব পাপুলই ঐ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। যে কোন মূল্যে তাকে জয়যুক্ত করে আনতে হবে। এর বছর পাঁচেক আগে ঐ এলাকায় পাপুলকে কেউ চিনতোই না। হঠাৎ করে কোথা থেকে এসে এলাকায় নানা রকম দান খয়রাত করে পাপুল পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। দু’হাতে টাকা উড়াতে থাকেন। ফলে নির্বাচনে বিজয় তার জন্য খুব একটা কষ্টকর হয়নি। কেউ কেন্দ্র দখল বুথ দখলে পাপুলের পক্ষে অর্থের বিনিময়ে কাজ করেছে এবং পাপুল এমপি হয়ে গেছেন। আহা বাংলাদেশের এমপি তৈরির কি আজব কল চালু হয়ে গেছে!

কিন্তু পাপুল শুধু নিজে এমপি হয়েই খান্ত থাকেননি। তিনি কোটি কোটি টাকা বিলিয়ে নিজের স্ত্রীকেও স্বতন্ত্র কোটায় এমপি করে নিয়ে এসেছেন। ভোট নয়, টাকার খেলাই এখানে প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু কি করে কোথায় এমন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাপুল পেয়েছিলেন। সেটি তখনও স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই জানা গেল পাপুল কুয়েতে অবৈধ পন্থায় বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ পাচার করেছেন। যাদের পাচার করেছেন, তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন নির্ধারিত টাকার বেশ কয়েকগুণ টাকা। পাচারকৃতদের যে টাকা বেতন দেবার কথা তা তো তিনি দেনইনি, বরং টাকা চাইলে এসব শ্রমিকের উপর নেমে এসেছে অত্যাচারের স্টীম রোলার।

কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিকের কণ্ঠস্বর কতদিন বন্ধ রাখা যায়। ঐ শ্রমিকরা কুয়েতের রাস্তায় বিক্ষোভ করতে শুরু করেন। ফলে সেখানে চরম আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। পাপুল ধুরন্দর লোক। তিনি অনুমান করেছিলেন যে, এই অসৎ কাজে কোন না কোন সময় তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতেই হবে। কুয়েতেও তিনি জমিয়েছিলেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এর বিপুল অংশ তিনি কুয়েতের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। পাচারও করেছেন বিপুল অংকের টাকা। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যান, বাংলাদেশের তথাকথিত এমপি সহিদ ইসলাম পাপুল। তাকে জেলে পোরা হয়। তার কাছ থেকে আটক করা হয় প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা। কুয়েতের একাধিক এমপি পাপুল কা-ে গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন।

তবে আশ্চার্য ঘটনা হলো এই যে, পাপুল গ্রেফতার হবার পরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংসদ বুঝতে পারছিল না যে, পাপুলকে নিয়ে কি করা উচিত। তারা বলছিলেন যে, আগে কুয়েত সরকার কিছু বলুক, তারপর দেখা যাবে পাপুলকে নিয়ে কি করা যায়। যেন পাপুল যে দোষী সেটি নিরঙ্কুশভাবে সাব্যস্ত হয়নি। পাপুলের টাকা তখনও কথা বলছিল। যারা যারা তার টাকা খেয়েছিলেন, তারা বেদিশার মত বক্তব্য দিচ্ছিলেন। ভাবখানা অনেকটা এমন যে, পাপুল নিয়ে কিছুই হয়নি, কিন্তু কুয়েতের সর্বোচ্চ আদালত পাপুলকে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছেন। এবার চক্ষু লজ্জায় পাপুলভক্তরা মুখ ফিরিয়েছে।

কিন্তু এর পরিণতি কি হলো, বাংলাদেশের তথাকথিত একজন সংসদ সদস্য শুধু নিজ দেশেই লুটেরা নয়। বিদেশের মাটিতেও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটের ফন্দি করেছে। এই হল একজন বাংলাদেশের সংসদ সদস্যের কোয়ালিটি। তাই শেষ পর্যন্ত আর পাপুলপ্রেম ধরে রাখা যায়নি। সরকারের লোকেরা তার হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

সংসদে পাপুলের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র কোটায় তার স্ত্রীর আসনের কি হবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। পাপুলের পাপ তার স্ত্রীকে কি রেহাই দেবে। তিনিও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন পাপের পথেই। এ পাপ যেনো কারো বাপকেও না ছাড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, যারা বিশেষ তনখার বিনিময়ে পাপুলকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কি কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না? এইচ টি ইমামকে কেউ কি জিজ্ঞেস করবেন না কিসের বিনিময়ে তিনি পাপুলকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করেছিলেন। পাপুলের টাকা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন এয়াতিম। এইচ টি ইমামের কত টাকা আছে কে জানে, কিন্তু রাজনৈতিভাবে তার মা-বাবার অভাব নেই।

সমাজের ভেতরে এই প্রক্রিয়া যতদিন কার্যকর থাকবে, ততদিন দুর্নীতির ফাঁক ফোকর গলিয়ে টাকার গর্বে ও গরমে হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে উঠবে। তারপর কবরের ম্যাগোটের মতো নিজের নিজেদের খেয়ে ধ্বংস করে ফেলবে। এইচ টি ইমামরা দীর্ঘজীবী কচ্ছপের মতো নাক জাগিয়ে টিকে থাকবে। জয় বাংলা।

https://dailysangram.com/post/444930