চুয়াডাঙ্গায় ট্রাকের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত ভটভটি। এ ঘটনায় ১৩ জন নিহত হন।
২৭ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ২:২৭

এক দিনে সড়কে শেষ ২৩ প্রাণ

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় বেপরোয়া গতির ট্রাকের চাপায় একটি ভটভটি লণ্ডভণ্ড হয়ে আরোহী ১৩ শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো অন্তত ৯ জন। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল রবিবার সকাল ৭টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সড়কের জয়রামপুর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ও আহতরা সবাই নির্মাণ শ্রমিক, তাদের বাড়ি উপজেলার বড় বলদিয়া গ্রামে। অন্যদিকে বাগেরহাটের কচুয়ায় বাসচাপায় রিকশা ভ্যান আরোহী দুজন, হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজার এলাকায় পাজেরোচাপায় এক শিশু, নাটোরে পাওয়ারটিলারের ধাক্কায় এক স্কুল ছাত্র, নরসিংদীতে বাস-লেগুনা সংঘর্ষে এক যাত্রী এবং খুলনায় যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে চারজন নিহত হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় বাসচাপায় নিহত হয়েছে একজন। আমাদের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, ভটভটি দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন আবদুর রহিমের ছেলে আবদার আলী (৪৫), ঠাণ্ডু মণ্ডলের ছেলে বিল্লাল হোসেন (৩৬), মৃত ইন্নাল হোসেনের ছেলে আকুব্বর হোসেন (৪৮), গোলাম হোসেনের ছেলে ইজ্জত আলী (৪২), কিতাব আলীর ছেলে নজির হোসেন (৩৬), গাজীর উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ শান্ত (৩৮), বাবুল আক্তারের ছেলে হাফিজুল রহমান (৩৫), ফিরোজ আলীর ছেলে শফিকুল রহমান (৩৭), কানাই মণ্ডলের ছেলে লাল মোহাম্মদ (৪৫), রমজান আলীর ছেলে রফিকুল আলম (৪০), ভোলাই মণ্ডলের ছেলে বিল্লাল হোসেন (৩৯), খোদা বকসের ছেলে জজ মিয়া (২৮) ও লিয়াকত আলীর ছেলে মোহাম্মদ শাহীন (২৫)।

চুয়াডাঙ্গার সহকারী পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, সকালে দামুড়হুদার বড় বলদিয়া গ্রামের ২২ জন শ্রমিক একটি ভটভটিতে করে রাস্তার নির্মাণ কাজের জন্য আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছিলেন। পথে দামুড়হুদার জয়রামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে বিপরীত দিক থেকে আসা বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক (চুয়াডাঙ্গা-ট-১১-০৫৮৮) ভটভটিটিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ভটভটির আট যাত্রী নিহত হন। পরে গুরুতর আহত ১৪ জনকে উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।
তরিকুল ইসলাম জানান, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে দুইজনের মৃত্যু হয়। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরো দুইজন মারা যান। বাকি একজনের মৃত্যু হয় দামুড়হুদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ঘাতক ট্রাকটি চুয়াডাঙ্গার নীলকমল ওয়েল মিলের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রতনের বলে জানা গেছে।

আহতরা হলেন—আলী হোসেন (৫৫), মোহাম্মদ কালু (১৯), মজিবর রহমান (২৫), জিয়াউর রহমান (৩৫), শফি উদ্দিন (২৪), আতিকুল ইসলাম (৩০), শফিকুল ইসলাম (২৭), আলতাফ হোসেন (৩০)। বাকি একজনের নাম জানা যায়নি।
চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ইনচার্জ আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে জানান, দুর্ঘটনার পরপরই দ্রুত তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। নিহতদের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ঘাতক ট্রাকটি আটক করে থানায় নিয়ে যায়।

ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, ভটভটিটি লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে। রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা লাশগুলো ছিন্নভিন্ন। শ্রমিকরা সঙ্গে করে দুপুরে খাওয়ার জন্য যে খাবার ও কাজের জন্য যে কোদাল নিয়ে যাচ্ছিলেন, সেসবও ছটিয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে রাস্তার ওপর। দুর্ঘটনার পরপরই জয়রামপুর গ্রামের বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তা ব্যারিকেড দেয়। এ সময় চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি শান্ত করলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
দামুড়হুদা থানার ওসি আবু জিহাদ মোহাম্মদ ফকরুল আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। তবে ট্রাকের চালক ও হেলপার আগেই পালিয়ে গেছে। নিহতদের স্বজনরা মামলা না করলেও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ওসি আরো জানান, লাশগুলো উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে নেওয়া হয়েছে। পরে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশগুলো তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
নিহতদের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস, সিভিল সার্জন ডা. রওশন আরা, পৌর মেয়র ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু প্রমুখ।

নিহতদের বড় বদলিয়া গ্রামটি মদনা-পারকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের আওতাধীন। ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিহতরা সবাই হতদরিদ্র। দিনমজুরি করে তাঁদের সংসার চলে। এ দুর্ঘটনা অনেক পরিবারকে পথে বসিয়ে দিল। ’

দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে।
পৃথক দুর্ঘটনায় আরো নয়জন নিহত : আমাদের বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, শনিবার রাত ৮টার দিকে সাইনবোর্ড-মোরেলগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের কচুয়া উপজেলার পিংগুড়িয়া এলাকায় বাসচাপায় রিকশা ভ্যান আরোহী দুইজন নিহত হন। তাঁরা হলেন কচুয়ার বিলকুল গ্রামের মোবারেক শেখের ছেলে খলিল শেখ (৩৫) এবং প্রতাপপুর গ্রামের আবদুল মাঝির ছেলে মাহবুব মাঝি (৪৫)।

কচুয়া থানার ওসি মো. কাবিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, মোরেলগঞ্জ থেকে কাজ শেষ করে রাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা ভ্যানে মাহাবুব ও খলিল বাড়িতে ফিরছিলেন। পথে পিংগুড়িয়া এলাকায় একটি বাস ভ্যানটিকে চাপা দিলে তাঁরা দুজন আহত হন। স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজার এলাকায় পাজারো জিপের চাপায় রিফাত মিয়া (৭) নামের এক শিশু নিহত হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার সুঘর নামক স্থানে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। নিহত শিশু বৈদ্যেরবাজারের বনগাঁও গ্রামের আবদুর রেজাক মিয়ার ছেলে।

স্থানীয়রা জানায়, হবিগঞ্জ থেকে বাহুবল যাওয়ার পথে সুঘর নামক স্থানে কাস্টমসের একটি পাজেরো জিপ (সিলেট ঘ-১১-০১৩৫) শিশুটিকে চাপা দেয়। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে বাহুবল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি ঘটলে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে বিকেল ৩টার দিকে শিশু রিফাত মারা যায়।
বাহুবল মডেল থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে জানান, বাহুবল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে গাড়ি রেখে চালক পালিয়ে গেছে। পুলিশ গাড়িটি জব্দ করে থানায় নিয়ে এসেছে।

নাটোর প্রতিনিধি জানান, দুপুরে নাটোরের লালপুর উপজেলার বাঘা সড়কের হাপানিয়া এলাকা দিয়ে সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আদনান (১০)। বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির একটি পাওয়ারটিলার ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে লালপুর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশ উদ্ধার করে। আদনান লালপুর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের হাফিজুল ইসলামের ছেলে।

খুলনা অফিস জানায়, গতকাল বিকেলে ডুমুরিয়া উপজেলার খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের টিপনা নতুন রাস্তা মোড়ে যাত্রীবাহী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে চারজন নিহত ও অন্তত ১৮ জন আহত হয়। আহতদের খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নিহতরা হলেন কৃষ্ণপদ মণ্ডল, রাজেশ সরদার, লাল্টু সরদার ও গোলক মিস্ত্রি। নিহতদের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ গ্রামে।

ডুমুরিয়া থানার ওসি সুভাষ সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি থেকে যাত্রীবাহী বাসটি সাতক্ষীরার শ্যামনগরে যাচ্ছিল। ডুমুরিয়ার টিপনা নতুন রাস্তার বাজার এলাকায় পৌঁছার পর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে থাকা একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে বাসটি খাদে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে তিনজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরো একজন মারা যায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ এসে আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে। দুর্ঘটনার পরই বাসচালক ও তাঁর সহকারী পালিয়ে গেছে। বাসটি উদ্ধারে হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট কাজ করছে।

নরসিংদী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, দুপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সদর উপজেলার সাহেপ্রতাপ এলাকায় যাত্রীবাহী বাস ও লেগুনার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে লেগুনার এক যাত্রী নিহত ও অন্তত ১০ জন আহত হয়। নিহত ফারুক ফকির (৩৮) সদর উপজেলার নজরপুরের কাঞ্চন ফকিরের ছেলে।

গুলিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু : রাজধানীর গুলিস্তানে গতকাল সকালে বাসের চাপায় সুজন নামের এক পথচারী নিহত হয়েছে। ওয়ারী থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের গোড়ায় বাসের চাপায় গুরুতর আহত হয় মো. সুজন নামের এক যুবক। পরে তাকে পথচারীরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মাছিমপুর গ্রামে। বাবার নাম আবু চান। বর্তমানে সে ঢাকা স্টেডিয়াম ভাসমান থাকত।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/03/27/479297